আমরা আমাদের দেশে বিভিন্ন দূষণ নিয়ে আলোচনা করি যেমন, পরিবেশ দূষণ, জল দূষণ ইত্যাদি। কিন্তু এই সময় আমাদের দেশের সমাজে মানুষের মনের দূষণই সব চাইতে মারাত্মক দূষণ। আমাদের সমাজে মানুষের মন সর্বদাই কলুষিত হচ্ছে, সমাজ যেন প্রতিনিয়ত মানুষের মনের কাছে দূষণের তরঙ্গ পাঠিয়ে চলেছে, জনগণের মনের ভিতরে সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে যে দূষণ আহরণ করে রাখছে, তা গ্রহণ করার আগে শোধন হচ্ছে না।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা, দুর্নীতির মহাউৎসব। যারা ধর্মজ্ঞান দান করেন, তারা বিভিন্ন কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের অনেকে জেল-জুলুম ও রিমান্ডে আছে। স্বাধীনতাকামী বাঙালির স্বপ্ন পূরণের ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ মাসে ৮ মার্চ নারী দিবসের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে শিক্ষায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টরেট একজন ব্যক্তি এক নারীকে “বেশ্যা” বলে অবহিত এবং শাড়ি ধরে টানা-হেঁচড়া করে লাঞ্ছিত ও শারীরিক শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালানোর খবর সময় টিভি, দৈনিক যুগান্তর সহ সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
আবার কিছুদিন আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা জনগণকে আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা দেখেছি। কিশোরদের নিয়ে গড়ে উঠছে অপরাধ সাম্রাজ্য। আমাদের দেশের কিশোরীরা মানসিকভাবে সংকটে রয়েছে। তারা মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সোশ্যাল মিডিয়া কিশোর বয়সের দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠেছে। তাছাড়াও রাজনীতিবিদ আর প্রশাসনের মহাদুর্নীতি, বিদেশীদের বিভিন্ন পদক্ষেপ, মন্ত্রীদের এমপিদের অনৈতিকতা, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা সমাজের মধ্যে এক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, যার বিষয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, পণ্ডিতমহল উদাসীন।
রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তারা এবং সমাজের ধনী ব্যক্তিদের দুর্নীতি সমাজের জনগণকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে, যার ফলে তাদের মাঝে এক ধরনের বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের লক্ষণ বিস্তৃতি পেয়েছে। আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ওপর বিশ্বাসের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ওপর দুর্নীতির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সমাজে দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী যাদের সঙ্গে ঘুষ ও দুর্নীতির সংযোগ নেই তারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে যুক্ত অসহায়ত্বের অনুভূতি অনুভব করছে, যখন তারা বুঝতে পারছে সমাজের ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে।
ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন যখন সমাজের অন্যদের দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করে না, তখন সাধারণ জনগণ দুর্নীতির শিকার হওয়ার ভয়ে মানসিক সমস্যায় আছে। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যে দুর্নীতির প্রভাব রয়েছে, যেমন- সংখ্যালঘু শিক্ষকদের ওপর হামলা, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিভিন্ন নিন্দাজনক ঘটনা, মানুষের মাঝে অতি অসহিষ্ণুতা, সংঘাত ইত্যাদি তার প্রমাণ।
আমাদের দেশে সরকারী খাত দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে সব প্রকার অনিয়মিত, অনৈতিক এবং বেআইনী লেনদেন। রাষ্ট্র বা সরকারী কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির দুর্নীতি সীমাহীন। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সমাজের প্রেক্ষাপটে সব ধরনের দুর্নীতি ঘৃণ্য এবং অবাঞ্ছিত। কারণ এটি সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক জীবন এবং কল্যাণের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দুর্নীতির অর্থনৈতিক পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্র বা একাডেমিকরা আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিণতি এবং দুর্নীতির কারণে প্রশাসন ও সরকারের ওপর আস্থার ক্ষয়ের কারণে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের জন্য যে বিপদ সৃষ্টি করে, তা অন্বেষণ করার জন্য তেমন গবেষণা ও পদক্ষেপ নেননি।
দুর্নীতির কর্মকাণ্ড সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা প্রায় সব সময়ই অসম্ভব। তাই সাধারণ জনগণের বিশ্বাস এবং দুর্নীতির ও দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যকলাপের কারণে তাদের মানসিক উপলব্ধি জানা প্রয়োজন। স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার লক্ষণ পরিমাপ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাবগুলো গবেষণা খুবই জরুরী।
আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের, সামাজিক চাপ, সাধারণ জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। সামাজিক চাপের প্রভাবে আয়ের ক্ষতি এবং বিশ্বাসের হ্রাস পাচ্ছে, যার মাধ্যমে দুর্নীতি মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। ভুক্তভোগীদের আয়ের অংশ থেকে ঘুষ প্রদান তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে এবং চাঁদাবাজির শিকার হয়ে তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা এবং স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে অসহায় হয়ে উদ্বেগ এবং হতাশায় নিমজ্জিত করছে। একজন ঘুষ গ্রহণকারী দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারী কর্মকর্তার ইচ্ছায় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জনপ্রশাসনে সেবা পেতে বঞ্চিত ভুক্তভোগীরা পদ্ধতিগত অন্যায় এবং অবিচারে শিকার হয়ে রাগ, শত্রুতা এবং হতাশ হয়ে উঠছে। যা উদ্বেগ এবং উদ্বেগের লক্ষণগুলোকে বাড়িয়ে তুলছে। অধিকন্তু, দুর্নীতি বা দুর্নীতির কেলেঙ্কারীর বৃদ্ধি গণমাধ্যমের ক্রমাগত রিপোর্ট সাধারণ জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে।
সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের দুর্নীতির কারণে সর্বসাধারণ জনগণের উচ্চতর প্রত্যাশাকে প্ররোচিত করছে যে, তিনি বা তাদের প্রিয়জনও দুর্নীতির শিকার হতে পারে। যার ফলে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের স্থানীয় শাসন এবং জবাবদিহির কাঠামোর ওপর নাগরিকদের আস্থা দুর্নীতির ধারণার কারণে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্নীতি নিজেই বা দুর্নীতির উপলব্ধি জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে এবং অন্যান্য কারণগুলো জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করেছে।
আমাদের দেশে দুর্নীতি এবং জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো দুর্নীতির উপলব্ধি এবং দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ উভয়ই কি রাষ্ট্রের জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একই প্রভাব ফেলে? এবং দুর্নীতির উপলব্ধি বা অংশগ্রহণের কোন দিকটি সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে এবং জনসাধারণের কোন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর? যেমন উত্তরে বলা যায়- পুলিশের সেবা পেতে ঘুষ প্রদান এবং চিকিৎসা সেবা পেতে ঘুষ প্রদান জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আরেকটি প্রশ্ন, আমাদের দেশে দুর্নীতিতে অংশগ্রহণের চেয়ে দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্নীতির প্রভাব দেখা কি জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশী প্রভাব ফেলছে? এবং ধনী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সরকারী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করতে পারে এমন ধারণা কি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত এ ধারণার চেয়ে জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশী প্রভাব ফেলছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা যায় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে (ক) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত, (খ) রাজনীতিবিদ এবং সরকারী কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত, (গ) সমাজের ধনী ব্যক্তিরা দুর্নীতি করতে পারেন, ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাদের সম্পদ ব্যবহার করেন এবং (ঘ) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত, যা জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশী প্রভাব ফেলছে।
দুর্নীতির প্রভাব বা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবের ফলে সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নারীরা ক্রমাগত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, ফলে মহিলারা বেশী ঝুঁকির শিকার। মহিলারা তাদের প্রিয়জনদের দুর্নীতির জন্য অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। ধর্ম মানুষের সামাজিক আচরণ ও কর্মকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিদের অনৈতিক এবং আইন বহির্ভূত আচরণ বা তাদের বিশ্বাস ভঙ্গতা বা অনৈতিক আচরণ, অনৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্ক সাধারণ জনগণের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে। প্রজম্ম ধর্মবিমুখ হচ্ছে অথবা অতি ধর্মীয় গোঁড়ামীতে আক্রান্ত। তাই ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা এর বড় প্রমাণ।
আমাদের দেশে একজন ব্যক্তির বসবাসের স্থান (অর্থাৎ গ্রামীণ বা শহুরে অঞ্চলে বাস করা বা উভয়ই) এবং দুর্নীতির উপলব্ধি এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ভিন্ন। গ্রামীণ-শহুরে বিভাজনে দুর্নীতির প্রকাশের স্তরের ভিন্নতা রয়েছে। কারণ শহুরে এলাকার বাসিন্দাদের গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের তুলনায় জনপ্রশাসনের সঙ্গে বেশী যোগাযোগ থাকে। ফলে গ্রামীণ বাসিন্দাদের দুর্নীতির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা কম এবং সেইজন্য, তাদের দুর্নীতির উপলব্ধির মাত্রা কম, তার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ওপর দুর্নীতির ধারণার প্রভাব কম পড়ে। সমাজে দুর্নীতিগ্রস্তদের সম্পদের স্থিতিস্থাপকতা এবং সাধারণ জনগণের দারিদ্র্যের ওপর দুর্নীতির সামাজিক প্রভাব বেশী এবং সমাজের সব স্তরে দুর্নীতি ক্ষমতা ও লোভের আচরণগত পরিণতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আমাদের দেশে দুর্নীতি বিভিন্ন মাত্রায় সমাজের সব স্তরে বিদ্যমান, অপর্যাপ্ত শাসনের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা এবং লোভের আচরণগত পরিণতি জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ