পবিত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর অস্থির হয়ে ওঠে মশলার বাজার। এ ঈদে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা মশলার দাম বাড়িয়ে দেন ইচ্ছামতো। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের এখনো দুই সপ্তাহের বেশী বাকী থাকলেও বাড়তি চাহিদাকে কেন্দ্র করে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের মশলার দাম। এমন দাম বৃদ্ধিকে ক্রেতাদের অনেকেই ‘আগুনের’ সঙ্গে তুলনা করছেন।
মাস খানেক আগে থেকেই অসাধু সিন্ডিকেট মশলা পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। দেড় মাস আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশী রসুন ১৩০ টাকায় বিক্রী হলেও এখন ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ৩০০ টাকা কেজি দেশী আদার দাম ৪৫০ টাকা হয়েছে।
এলাচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০০ টাকা। আর বাজারে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দেশের শতাধিক ব্যবসায়ীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি ‘মার্কেট প্রাইস’ বিক্রী উৎসবে ঈদের আড়াই মাস আগে থেকেই মশলা পণ্য কিনতে ঠকছেন প্রায় ১৭ কোটি ভোক্তা। মশলা পণ্যের বাজারে কারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে তার একটি প্রতিবেদন গত বছর মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানে ঢাকা, চট্টগ্রামের ও দু-একটি অঞ্চলের শতাধিক ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে তারা যা খুশী তাই করছে।
সূত্র জানায়, রসুনের শীর্ষ আমদানীকারক ২০টি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানী হওয়া পেঁয়াজের শীর্ষ আমদানিকারক একে ট্রেডিং, সুরমা টেপ, মক্কা এন্টারপ্রাইজ, জেনি এন্টারপ্রাইজ ও এনএন এন্টারপ্রাইজ। সবচেয়ে বেশী আদা আমদানী করা চার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে— বগুড়ার মিশু ট্রেডিং, ঢাকার ট্রেইটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, বগুড়ার বিকে ট্রেডার্স ও ঢাকার ভাই ভাই বাণিজ্যালয়।
সবচেয়ে বেশী এলাচ আমদানী করে চট্টগ্রামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি জিরা, দারুচিনি, হলুদ, মরিচ ও জয়ত্রী আমদানী করা হয়। এসব পণ্যেরও নিয়ন্ত্রক ঘুরে-ফিরে ৩০ থেকে ৪০ জন। এছাড়া চট্টগ্রাম পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জের মার্কেট প্রাইস বিক্রি উৎসবে মশলা পণ্যের দাম আরেক ধাপ বেড়ে যাচ্ছে। পাইকারী পর্যায়ে প্রতি কেজি পণ্যের যৌক্তিক দাম যা হওয়ার কথা, বাজার নিয়ন্ত্রকরা দুই থেকে তিনগুণ এমনকি চারগুণ বেশী দামে বিক্রি করছেন। ফলে বাজারে অন্য বিক্রেতারাও সেই দাম অনুসরণ করে পণ্য মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
এতে স্বাভাবিকভাবেই বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। বেশী দামে বিক্রীর কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেন, পণ্যটি এক বছর আগে আনা হয়েছে; গোডাউনে ছিল। এক বছর বিক্রি হয়নি। সেই হিসাব ধরে লাভ করতে দাম বাড়ানো হয়। এছাড়া ‘মার্কেট প্রাইস’ যে দামে থাকে সবাই সেই দামে বিক্রি করে। এটা ভোক্তাদের সঙ্গে তাদের এক ধরনের প্রতারণা। এমন পরিস্থিতিতে আমরা জড়িত ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনছি। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সবখানেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা, রসুন, জিরা, এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গসহ বেশ কিছু ধরনের মশলাপণ্য। এর জন্য ব্যবসায়ীরা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে দায়ী করছেন। তবে ভোক্তারা বলছেন, অতি মুনাফার লোভে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এভাবে একটার পর একটা জিনিসের দাম বেড়েই চলছে। ঢাকার পাইকারী ও বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশী দাম বেড়েছে এলাচের। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এলাচের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশী। অন্যান্য মশলার মধ্যে জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গের দাম গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আমদানী করা এলাচ এখন মানভেদে প্রতি কেজি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও দাম ছিল ২ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
পাইকারীতে প্রতি কেজি লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকায়। এক মাস আগে ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। কেজিতে ১০০-২০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি গোল মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ ও সাদা গোলা মরিচ ১ হাজার ১০০ টাকায়। জিরা এক মাসে ৫৮০-৬২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন প্রতি কেজি ৭৫০-৯২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধনের কেজি এখন ২০০ থেকে ২৪০ টাকা আর তেজপাতা ১৫০-২০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গেল প্রায় দুই বছরে ডলারের দাম ৩৫ শতাংশের বেশী বেড়েছে। ডলারের অভাবে এলসি খোলায় সমস্যা হয়েছে। নগদ অর্থ জমা দিয়েও খোলা যায়নি। এলসি যদিও খোলা গেছে, ব্যাংক-দরের বেশী দরে ডলার কিনতে হয়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারী গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি আতিকুল হক বলেন, ‘এবার ভারতেও এলাচের দাম বেশি। নতুন করে কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ বেড়েছে। মশলার বাজার চড়া।’
এদিকে প্রতিদিনই অস্থির হয়ে উঠছে মসলাপণ্য এলাচের বাজার। দেশে তিন ধরনের এলাচ আমদানী হয়। এর মধ্যে বড় দানার সবচেয়ে উন্নত এলাচ আসে ভুটান থেকে। মাঝারী সাইজের মোটামুটি ভালো মানের এলাচ আসে গুয়াতেমালা থেকে। এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া থেকেও কিছু এলাচ আমদানী হয়। দেশে মসলাপণ্য এলাচের বার্ষিক চাহিদা ৮ হাজার টনেরও কম বলে ধারণা করা হয়। তবে দেশের বৃহত্তম পাইকারী বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কেনাবেচার মাধ্যমে প্রতিদিন ১ হাজার টনেরও বেশী এলাচ ব্যবসায়ে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে এ মশলা পণ্যের বাজার।
বাংলাদেশ পাইকারী গরম মশলা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, ‘দেশে বছরে এলাচের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬০০ টন। অথচ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজারেই প্রতিদিন হাজার টনের বেশী এলাচ ট্রেডিং হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন মশলা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।’
আমদানিকারকদের তথ্যমতে, দেশে আমদানী হওয়া এলাচের বেশিরভাগই আসে গুয়াতেমালা থেকে। এলএমজি, জেবিস, আরএস-জাম্বো, এসএমজি, এসবি ব্রান্ড নামে আমদানী হওয়া এসব এলাচের মধ্যে মাঝারী মানের জেবিসি ও এলএমজি’র চাহিদা বেশী বাজারে। চলতি বছর ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ১৩টি প্রতিষ্ঠান ২৩৭ টন ৮০ কেজি এলাচ আমদানী করেছে। ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের দাম পড়েছে ১,২৬৭ টাকা। গত বছর ২০২৩ সালে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান ৪,৬৭৭ টন ২৯০ কেজি এলাচ আমদানী করে। আমদানীকারকদের ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতিকেজি এলাচের আমদানী খরচ পড়ে ১,২৫৭ টাকা করে।
এর আগে, ২০২২ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান রেকর্ড ৬ হাজার ১ টন ২০৫ কেজি, ২০২১ সালে ৭০টি প্রতিষ্ঠান ৪,৩৯৫ টন ৮০ কেজি, ২০২০ সালে ৬০টি প্রতিষ্ঠান ৩,১০১ টন ৬৮৩ কেজি এবং ২০১৯ সালে ৫০টি প্রতিষ্ঠান ৩,৬৭১ টন ২৫৬ কেজি এলাচ আমদানী করে। আমদানীকার ও ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৮ সালে গুয়াতেমালায় এলাচ উৎপাদন কম হওয়ায় পণ্যটির দাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরী হয়। ওই সময় প্রতিকেজি এলাচ ১,৫০০-২,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫,০০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। পরের দুই বছর আমদানীকারকরা এলাচ আমদানী কমিয়ে দেন। অস্থিরতার সুযোগে খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ২০২২ সালের দিকে এলাচে বিনিয়োগ শুরু করেন। এরপর থেকে পণ্যটির আমদানী বাড়তে থাকে দেশীয় বাজারে।
এলাচের আমদানীকারক রশিদ-উন-নবীর দাবী, এখন এলাচ আমদানীতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ককর দিতে হয়। এই এলাচ শুল্কায়ন করা হয় ২৫ ডলারে, অথচ এর আমদানী মূল্য সাত ডলার। শুল্কায়ন মূল্য বেশী ধরার কারণে কেজিতে শুল্ককর বেশী দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। যে কারণে দাম হু হু করে বাড়ছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারা ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। যা ১ মাস আগেও ৬০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি দেশী রসুন বিক্রী হচ্ছে ২০০ টাকা। যা ১ মাস আগে ১৩০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি শুকনামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ টাকা। যা এক মাস আগে ৩৭০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা; যা এক মাস আগে ৩২০-৩৩০ টাকা ছিল।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশী আদা ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা এক মাস আগে ২৫০ টাকায় বিক্রী হয়েছে। আমদানী করা আদা বিক্রী হচ্ছে ২৪০-২৫০ টাকা; যা এক মাস আগে ২২০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি দারুচিনি ৬২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা এক মাস আগে ৫২০ টাকা ছিল। ছোট দানার এলাচের কেজি সর্বোচ্চ ৩৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা এক মাস আগে ৩৫০০ টাকা ছিল।
এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতি বছর কুরবানির ঈদ আসার আগেই অসাধুরা মশলা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কারণ কুরবানির ঈদ ঘিরে এ পণ্যের চাহিদা বেশী থাকে। কয়েকবার অসাধুদের চিহ্নিত করলেও পদক্ষেপ নেয়া হওয়নী। তাই এখনই পদক্ষেপ না নিলে ঈদের আগেই মূল্য ক্রেতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
কাওরান বাজারে মসলা বিক্রেতা মো. ইউনুস বলেন, কুরবানির ঈদ আসলেই আমদানীকারকরা মশলা পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। এবারও তাই হয়েছে। আমরা পাইকারী কিনে খুচরায় বিক্রি করি। পাইকারী পর্যায়ে দাম বাড়লে খুচরায় দাম বাড়ে। তিনি বলেন, দেশে সব ধরনের মশলা পণ্য আমদানী নির্ভর। আর এ বাজার গুটিকয়েক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন। কারা নিয়ন্ত্রণ করেন তা সরকারের সব বিভাগ জানে। তাই সেখানে অভিযান পরিচালনা করলে ক্রেতার স্বস্তি ফিরবে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ