বাংলাদেশ বুঝি একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে নিজেই নিজেকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া যায়। আমরাই একমাত্র জাতিরাষ্ট্র যারা ঘূর্ণিঝড়ের ১০ নম্বর বিপদ সংকেত উদযাপন করতে সমুদ্রে গিয়ে নর্দনকুর্দন করতে পারি। টিকটক বানিয়ে ভিউ কামাতে পারি। আমরাই বোধ হয় এমন কেবল আপনারে নিয়েই ভাবতে পারি!
আমাদের গণমাধ্যমগুলোও আরেক কাঠি সরেস। দমকা হাওয়ার ধাক্কা সয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কোমর পানিতে ডুবে ঝড় বিলাসীদের ক্যামেরার সামনে ডেকে এনে বলছে, আপনার অনুভূতি কেমন হে ঝড়ের রাজা অথবা রানী? ঘূর্ণিঝড়কে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ইনপুট করিয়ে দৃষ্টিনন্দন ছবি বানিয়ে বলে দিচ্ছি, আহা কী সুন্দর ঘূর্ণিঝড়ের মুখচ্ছবি!
অথচ গণমাধ্যমের প্রধান কাজ ছিল এটা বলা যে, কেন হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ থাকতে ফসলি জমিতে লবণ পানি ঢুকে পড়ল। তাহলে বাঁধ নির্মাণে কি কোনো গলদ ছিল। এখন কিভাবে জমি থেকে দ্রুত লবণ পানি অপসারণ করা যাবে। কেন আমরা সিডরসহ অতীতের ঘূর্ণিঝড়গুলো থেকে যথোচিত নিয়ম মেনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিখলাম না?
সরকারী-বেসরকারী সহায়তা দুর্গত এলাকায় ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা এটা গণমাধ্যমের খবর হওয়া উচিৎ। খুলনা, পটুয়াখালী বা কক্সবাজারের হাজারো মানুষের পাতে ভাত উঠছে না, পানীয় জল পাচ্ছে না অনেকেই। সবচেয়ে বেশী দুর্বিপাকে পড়েছেন সন্তানসম্ভবা নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। সেসব অসহায় মানুষ কিভাবে দিন পার করছে মিডিয়ার কাছে আমরা এসব জানতে চাই। ঘূর্ণিঝড়ের দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে টিকটকারদের শারীরিক কসরত দেখার মতো মানসিকতা আমাদের কারোরই নেই। বিপদ নিয়ে মজা চলে না। চলে না ফালতু উন্মাদনা।
ভবিষ্যতে সরকারকে নোটিশ জারী করে বলে দিতে হবে যে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত বাড়ার কালে কেউই আসলে সমুদ্রের সীমানায় গিয়ে বিলাসিতা করতে পারবে না। আমাদের ঘটে যখন আপনাআপনি বুদ্ধি খুলবে না, তখন নীতিনির্ধারকদের উচিৎ হবে আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা।
আমরা কেমন জানি হয়ে গেছি। উপকূল প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। আর এদিকে অনেকেই খিচুড়ি রান্না করে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে সুখ সংগীত গাইতে গাইতে বেপরোয়া রোমান্টিসিজমে মেতে উঠেছিল। অনেককেই দেখলাম ঝড়ের বৃষ্টিকে আশীর্বাদ বিবেচনায় নানা আয়োজনে মেতে উঠতে।
কিন্তু এই বৃষ্টি মোটেও আনন্দের ছিল না। সেটা কে কাকে বুঝাবে? ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট নিম্নচাপের বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া মানে গজব, মহাদুর্ভোগ। খিচুড়ি খেয়ে রোমান্স করার জন্য আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের পুরোটা পড়ে আছে। সেসময় আমরা চুটিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব। কিন্তু এই সময় মানুষের দুঃখ না বুঝলে নিজের নাম আর মানুষ থাকে কেমনে?
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্রায় সারা দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে। না আছে ইন্টারনেট সেবা, না আছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। মোটর চালিয়ে খাবার জল তোলা যাচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। দমকা হাওয়া ও ক্রমাগত বৃষ্টিতে জমির ফসল ভূমিতে মিশে গেছে। সবজি বাগান প্রায় নেই হয়ে গেছে। ছাদ বাগানের গাছেরা রীতিমতো ধুকছে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠালও তাদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ডুবে গেছে জলে।
আর উপকূলবাসীর অবস্থা?
অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন হাজারো মানুষ। ফসলি জমিতে লবণ পানি ঢুকে বিনষ্ট হয়ে গেছে সব। ভেসে গেছে শত শত বিঘার চিংড়ির ঘের। কাঁচা ঘর ধসে পড়েছে। গবাদি পশুর দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অনেকের বাড়িতেই গলা সমান পানি। সুন্দরবন ঢাল হয়ে প্রকৃতি বাঁচাতে গিয়ে হারিয়েছে তার মূল্যবান বৃক্ষরাজি, মায়া হরিণ বা অন্যান্য জীববৈচিত্র্য।
এই লেখাটি লেখার সময় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ উপকূলবাসী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯ জেলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে সাড়ে ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত এক লাখ ১৫ হাজার ঘর। জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে অনেকের।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ৭০১ কোটি ৪১ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দুর্বিপাকে পড়া মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির প্রতি মর্মপীড়া বোধ করব না আমরা? সমব্যথী হবো না তাদের? আমাদের হূদয়ে কি দয়া ও মায়া বলে কিছু থাকতে নেই। মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া, সহমর্মী হওয়া, বিপদগ্রস্তের প্রতি ভালোবেসে সহানুভূতি দেখানোর মতো মহানুভবতা আমরা কোনোদিন রপ্ত করব না?
আমরা আর কবে বুঝব যে,/“এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি চলে যেও না/ বৃষ্টিরও ছন্দে বকুলেরও গন্ধে/ আমায় তুমি ফেলে যেওনা।”
-এই লগন এমন রোমাঞ্চকর গান শোনাবার নয়। আমাদেরকে এখন সমস্বরে গাইতে হবে...
“মানুষ মানুষের জন্যে,/ জীবন জীবনের জন্যে।/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?/ ও বন্ধু.
আমরা তো এমন ছিলাম না। এক তিল চল্লিশ জনে ভাগ করে খাওয়ার পুরাণ কথা আমাদের জানা ছিল। পরহিতে মনোনিবেশ করার কথা ধর্মপুরাণ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছিল। রোম নগরী যখন পুড়ছিল নিষ্ঠুর রোম সম্রাট নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেই নিরোর বংশধরেই কী তবে ভরে গেল বাংলার উঠোন?
মৌসুমী বৃষ্টি বন্দনায় রবিঠাকুর-জীবনানন্দ দাশ অনেক কাব্য গাঁথা নির্মাণ করেছেন। আমরাও সেসব গীতি আলেখ্য সানন্দে গ্রহণ করে বৃষ্টিবিলাসে মাতি। কিন্তু রেমালের মতো ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণিপাক নিয়ে কবিতা গান? তেমন একটা শুনিনি।
আমরা কী খাই? কী দেখি? কোথা থেকে অর্জন করছি আমাদের আজকের উপলব্ধি। এভাবে বিবেক ও বোধ কি করে খুইয়ে বসলাম আমরা? কেমন করে এমন আত্মস্বার্থ নিমগ্ন হয়ে পড়লাম সবাই? কারো ব্যথাই আমাদের মনে দাগ কাটবে না? নিজে ভালো থাকার নাম আদৌ আনন্দে থাকা হয়?
আমার সুহূদ, স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, পাড়া প্রতিবেশী, দেশের মানুষ যদি ভালো না থাকে কাকে দেখাব আমাদের এই রং ঢং? অন্যকে না ভালোবাসলে নিজেকে ভালোবাসতে শিখব কখন? তুল্য মূল্যের যত্ন না করলে নিজেকে মূল্যায়ন করব কার পরাকাষ্ঠায়? আমি কি কেবলই আমার? কখনোই নয়। কারণ আমার বিনির্মাতা তো আমি নই। সবাই মিলেই তবে আমি এই মানুষ। আমাদের মনুষ্যত্ব দিয়ে যদি মহত্তম সময়কে ধারণ করতে না পারি তবে তো মানবজনম পুরাই বৃথা।
আপনভোলা নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করার নাম শুদ্ধাচার নয়। আপনি যখন সব মানুষকে বুঝবেন, গণনায় কোচিত শুদ্ধাচার পুরস্কার এমনিতেই আপনার হবে। জগৎ ভালোবেসে ওটাই আমরা নিয়ে নিই না কেন? কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ আমাদের সবার হোক।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি / জীবন মন সকলি দাও।/তার মত সুখ কোথাও কি আছে?/আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ