দেশে চাষের আওতায় রয়েছে প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমালের দ্বারা, যা মোট আবাদি জমির প্রায় ৬৯ শতাংশ। এর ভুক্তভোগী দেশের ৪৮ জেলার কৃষক।
কৃষকদের এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখনই প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ, আগামী মৌসুমের জন্য উপকরণ সহায়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাদের নিবিড়ভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশের সবজি এলাকা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে যশোরের। যশোর সদর উপজেলার নোঙ্গরপুর এলাকার সবজি কৃষক হাবিবুর রহমান এবারে করলা চাষ করেছিলেন তিন বিঘা জমিতে। ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষেতেই পড়ে গেছে তার করলার মাচা। এলাকার অন্য কৃষকদের মতো তিনিও স্বপ্ন দেখছিলেন করলা বিক্রি করে লাখ টাকা আয় করবেন।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো তার স্বপ্ন।কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার দুডো ক্ষেতেরই মাচা পইড়ে গেছে। দুডোই এখন শেষ। ঘূর্ণিঝড়ে আমার ফলন নেই হইয়ে গেল।
লাখ টাকার ওপরে ক্ষতি হয়ে গেছে। ফল উঠার মুখি এ ঝড় করলার মাচার সঙ্গে আমার মাজা (কোমর) শুয়ায় (শুইয়ে) দিয়ে গেল। আগামী মৌসুমে কী করব, সেটি নিয়ে এখন চিন্তায় আছি।’
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সামনের দিনে বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ হতে পারে। এ জন্য দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে বিনষ্ট হয়েছে পটুয়াখালী উপজেলার গলাচিপা উপজেলার ১০ হাজার কৃষকের ৮৫৫ হেক্টর কৃষিজমির বিভিন্ন ফসল। মাত্র কয়েক দিন আগেই খরার কবলে পড়া এসব কৃষক ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। খরা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছে রিমাল। উপজেলায় প্রায় ১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
গলাচিপা সদর ইউনিয়নের পশ্চিম রতনদী গ্রামের কৃষক মোস্তফা হাওলাদার বলেন, ‘আমি ১২০ শতক জমিতে আউশ ধানের বীজতলা করি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে আমার সব শ্যাষ কইরা দিছে। ধারদেনা কইরা বীজ লাগাইছি (রোপণ করছি)। নতুনভাবে চাষ করতে করতে আমনের সময় এসে যাবে। জানি না কপালে কী আছে।’
আমখোলা গ্রামের চিনাবাদাম চাষি নুর ইসলাম বলেন, ‘এক একর জমিতে চিনাবাদাম চাষ করেছিলাম। কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিটেই আমার সব শ্যাষ করে দিছে।’
বাদ যায়নি উত্তরাঞ্চলের জেলাও। জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের পাকা-আধাপাকা বোরো ধানসহ সবজি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অতিমাত্রায় ভারী বৃষ্টির কারণে জমিতেই ভাসছে কৃষকের স্বপ্নের সোনালি ধান। পানিতে তলিয়েও রয়েছে শত শত হেক্টর জমির পাকা ধান। হাজার টাকার দিনমজুরিতেও মিলছে না ধান কাটার শ্রমিক। বাধ্য হয়েই নিজেরাই হাঁটুপানিতে নেমে ধান কাটছেন। কেউ কাটা ধান রাস্তার উঁচু স্থানে তুলছেন, আবার কেউ কাটা ধানগুলো পানিতে ভাসমান অবস্থায় একত্র করছেন।
ক্ষেতলাল উপজেলার কাচাকুল গ্রামের কৃষক ফজলুর রহমান বলেন, ‘পাকা ধান পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। দুই দিনের বৃষ্টির পানিতে ধান তলিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে দ্রুত ধান কাটার জন্য সিরিয়াল দিয়েও বেশি মজুরিতে শ্রমিক নিতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব করা হয়েছে। দেশের কতজন কৃষক কী পরিমাণ ক্ষতির শিকার হয়েছে তার একটি আর্থিক হিসাব করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৪৮ জেলার এক লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত ১০ জেলার কৃষকের কাছে প্রণোদনা পৌঁছানোর পরিকল্পনা করছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরো জানান, মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত থেকে কিভাবে সর্বোচ্চ ভালো ফসল পাওয়া যাবে, তার উপায়গুলো কৃষকদের দেখানো হচ্ছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ