বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এদেশে প্রতিবছর কোনো না কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি কমানোই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যথাযথ প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫০টির ওপরে অভিন্ন নদী আছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে তিস্তা-গঙ্গাসহ যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক। ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে খরা এবং বর্ষাকালে বন্যার কবলে পতিত হয়। ভারত সীমান্তে শুধু ফারাক্কা বাঁধই নয়, তিস্তাসহ প্রায় সবক’টি নদীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন মনিটরিং করা দরকার। এক্ষেত্রে ওয়াটার ডিপ্লোম্যাসি আরো জোরদার করা বাঞ্ছনীয়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি-প্র্যাকটিস গ্যাপটা কমানো জরুরী। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। যেমন, জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯ তে বর্ণিত অংশীদার ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাসহ বেশীর ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ের ওপর কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে এদেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির সঙ্গে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানেরও প্রয়োগ দরকার।
বন্যা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা “ডেলটা প্ল্যান ২১০০” প্রস্তুত করার প্রায় দুই বছর হচ্ছে, এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। এই প্ল্যান বাস্তবায়নে, সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ২ বিলিয়ন ইউএস ডলার পাওয়ার জোড় তৎপরতা চালাচ্ছে এবং গ্রীন সিগন্যালও পেয়েছে। এ অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রকৃতি ভিত্তিক সল্যুশনের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। অন্যান্য স্ট্র্যাটেজি ও পলিসির মতো এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে জাতীয় পর্যায়ের অভীষ্ট লক্ষ্য, যেমন ২০৩০ সালের মধ্যে (ক) চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ, (খ) উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং (গ) একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন সম্ভব হবে।
সারকথা হলো, টেকসই দুর্যোগ মোকাবিলা অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধানের ওপর। আইপিসিসি’র পঞ্চম অ্যাসেসমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সফল না হলে নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত-সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বে করণীয়: ১. দুর্যোগের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবে, গরু মহিষাদি কোথায় থাকবে তা আগে ঠিক করে রাখুন এবং জায়গা চিনিয়ে রাখুন। ২. বাড়ীতে, গ্রামে, রাস্তায় ও বাঁধের ওপর গাছ লাগান। ৩. যথাসম্ভব উঁচু স্থানে শক্ত করে ঘর তৈরী করুন। পাকা ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিয়ে তার ওপর ছাউনী দিন। ছাউনীতে টিন ব্যবহার না করা ভালো। কারণ ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদী পশুকে আহত করতে পারে। তবে ০.৫ মিমি পুরুত্ব বিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করা যেতে পারে। ৪. উঁচু জায়গায় টিউবওয়েল স্থাপন করুন, যাতে জলোচ্ছ্বাসের লোনা ও ময়লা পানি টিউবওয়েলে ঢুকতে না পারে। ৫. জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারে রেডিও রাখুন। সকাল, দুপুর ও বিকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন। ৬. সম্ভব হলে বাড়ীতে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম (ব্যান্ডেজ, ডেটল প্রভৃতি) রাখুন। ৭. জলোচ্ছ্বাসের পানির প্রকোপ থেকে রক্ষায় নানা রকম শস্যের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।
৮. বাড়ীতে এবং রাস্তায় নারিকেল, কলাগাছ, বাঁশ, তাল, কড়ই ও অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান। এসব গাছ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ কমিয়ে দেয়। এর ফলে মানুষ দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচতে পারে। ৯. নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে প্রত্যেকেরই সাঁতার শেখা উচিৎ। ১০. ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বা অন্য আশ্রয়ে যাওয়ার সময় কী কী জরুরী জিনিস সঙ্গে নেয়া যাবে এবং কী কী জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখা হবে তা ঠিক করে সে অনুসারে প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ। ১১. আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ঘরের মধ্যে একটি পাকা গর্ত করুন। জলোচ্ছ্বাসের পূর্বে এ পাকা গর্তের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারবেন।
১২. ডায়রিয়া মহামারীর প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। শিশুদের ডায়রিয়া হলে কিভাবে খাবার স্যালাইন তৈরী করতে হবে সে বিষয়ে পরিবারের সবাইকে প্রশিক্ষণ দিন। ১৩. ঘূর্ণিঝড়ের মাসগুলোতে বাড়ীতে মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাবার রাখা ভালো। ১৪. নোংরা পানি কিভাবে ফিটকারী বা ফিল্টার দ্বারা খাবার ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায় সে বিষয়ে নারীদের এবং আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিন। ১৫. ঘূর্ণিঝড়ের পরে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করুন। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ। মাটির বড় হাঁড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যাতে পোকামাকড়, ময়লা আবর্জনা ঢুকতে না পারে।
পূর্বাভাস পাওয়ার পর দুর্যোগকালে করণীয়: ১. আপনার ঘরগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করুন, আরো মজবুত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যেমন- মাটিতে খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘরের বিভিন্ন অংশ বাঁধা। ২. সিপিপি এর স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন। ৩. বিপদ সংকেত পাওয়া মাত্র বাড়ীর মেয়ে, শিশু ও বৃদ্ধাদের আগে নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে প্রস্তুত হোন এবং অপসারণ নির্দেশের পরে সময় নষ্ট না করে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যান। ৪. বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার সময় আগুন নিভিয়ে যাবেন। ৫. আপনার অতি প্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যসামগ্রী যেমন- ডাল, চাল, দিয়াশলাই, শুকনো কাঠ, পানি ফিটকিরি, চিনি, নিয়মিত ব্যবহূত ওষুধ, বইপত্র, ব্যান্ডেজ, তুলা, ওরস্যালাইন ইত্যাদি পানি নিরোধন পলিথিন ব্যাগে ভরে গর্তে রেখে ঢাকনা দিয়ে পুঁতে রাখুন। ৬. আপনার গরু-ছাগল নিকটস্থ উঁচু বাঁধে অথবা কিল্লা বা উঁচু স্থানে রাখুন। কোনো অবস্থায়ই গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখবেন না।
কোনো উঁচু জায়গা না থাকলে ছেড়ে দিন, বাঁচার চেষ্টা করতে দিন। ৭. শক্ত গাছের সঙ্গে কয়েক গোছা লম্বা মোটা শক্ত রশি বেঁধে রাখুন। রশি ধরে অথবা রশির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখুন যাতে প্রবল ঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিতে না পারে। ৮. আশ্রয় নেয়ার জন্য নির্ধারিত বাড়ীর আশপাশে গাছের ডালপালা আসন্ন ঝড়ের পূর্বেই কেটে রাখুন, যাতে ঝড়ে গাছগুলো ভেঙে বা উপড়িয়ে না যায়। ৯. রেডিওতে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনতে থাকুন। ১০. দলিলপত্র ও টাকা-পয়সা পলিথিনে মুড়ে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখুন অথবা সুনির্দিষ্ট স্থানে পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখুন। ১১. টিউবওয়েলের মাথা খুলে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং টিউবওয়েলের খোলা মুখ পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে আটকে রাখতে হবে যাতে ময়লা বা লবণাক্ত পানি টিউবওয়েলের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
দুর্যোগ পরবর্তী করণীয়: ১. রাস্তাঘাটের ওপর উপড়ে পড়া গাছপালা সরিয়ে ফেলুন যাতে সহজে সাহায্যকারী দল আসতে পারে এবং দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়। ২. আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষকে বাড়ী ফিরতে সাহায্য করুন এবং নিজের ভিটায় বা গ্রামে অন্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিন। ৩. অতি দ্রুত উদ্ধার দল নিয়ে খাল, নদী, পুকুর ও সমুদ্রে ভাসা বা বনাঞ্চলে বা কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করুন। ৪. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যাতে শুধু এনজিও বা সরকারী সাহায্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজে যেন অন্যকে সাহায্য করে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। ৫. রিলিফের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সচেষ্ট হোন। রিলিফের পরিবর্তে কাজ করুন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করুন। রিলিফ যেন মানুষকে কর্মবিমুখ না করে কাজে উৎসাহী করে সেভাবে রিলিফ বিতরণ করতে হবে। ৬. দ্বীপের বা চরের নিকটবর্তী কাদার মধ্যে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের জন্য দলবদ্ধ হয়ে দড়ি ও নৌকার সাহায্যে লোক উদ্ধার কর্ম শুরু করুন। কাদায় আটকে পড়া লোকের কাছে দড়ি বা বাঁশ পৌঁছে দিয়ে তাকে উদ্ধার কাজে সাহায্য করা যায়।
৭. ঝড় একটু কমলেই ঘর থেকে বের হবেন না। পরে আরো প্রবল বেগে অন্যদিক থেকে ঝড় আসার সম্ভাবনা বেশী থাকে। ৮. পুকুরের বা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করুন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখুন। ৯. নারী, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ লোকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ত্রাণ বণ্টন (আলাদা লাইনে) করুন। ১০. দ্রুত উৎপাদনশীল ধান ও শাকসবজির জন্য জমি প্রস্তুত করুন, বীজ সংগ্রহ করুন এবং কৃষিকাজ শুরু করুন, যাতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফসল ঘরে আসে। ঝড়ের তাণ্ডবসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি জারী রাখতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করে পুনর্বাসনেও উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব- যা আমলে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারী রাখতে হবে। এবারে ঝড়ের তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমলে নেয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। একইসঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে সামগ্রিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ