শেষ হলো ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সম্পন্ন হয়েছে ভোটগ্রহণ। গতকাল বুধবার ৮৭ উপজেলায় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড় ও মামলা জটিলতায় ২৫ উপজেলায় ভোট স্থগিত করা হয়। তবে শত চেষ্টা করেও ভোটারদের কোনো সাড়া মেলাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের মতোই এবারও ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এক্ষেত্রে ব্যর্থ প্রার্থীরাও। তৃতীয় ধাপেও বেশির ভাগ উপজেলায় মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরই লড়াই হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন উপজেলা ভোটে ফাঁকা মাঠে গোল দিল আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীরা।
নির্বাচনে দু-একটি জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও কোথাও বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটেনি। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। সকালের তুলনায় বেলা বাড়ার পর ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়ে। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভাষায় ভোট শান্তিপূর্ণ হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করা হয়।
তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে কমবেশি ৩৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, এটা ৩৫ শতাংশের কমও হতে পারে, বেশিও হতে পারে। নিশ্চিত ফিগার পেতে ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা সময় লাগবে। গতকাল বুধবার বিকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
সিইসি বলেন, ৮৭ উপজেলায় ভোট হয়েছে। ইভিএমে ১৬ উপজেলায় ভোট হয়েছে। নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো ভূমিকা পালন করেছে। ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আরও বলেন, সীমিত পরিসরে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে তারা ভোট কারচুপির চেষ্টা করছিলেন। সর্বোপরি ভালো ভোট হয়েছে।
সিইসি বলেন, খুবই সীমিত পরিসরে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ভোট কারচুপির চেষ্টায় ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। দুজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সংঘর্ষ ঘটনায় ছয় জন আহত হয়েছে। একজন প্রিসাইডিং অফিসার অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচন মোটামুটি হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল। দুই-চারটি অনভিপ্রেত ঘটনা ছাড়া যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।
ছয় প্রিসাইডিং অফিসার প্রত্যাহার: বগুড়া শহরের জুবিলী ইন্সটিটিউশনের দু’টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণে অনিয়মের অভিযোগে দুই প্রিসাইডিং অফিসারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া ভোটার আসার আগেই ব্যালটে সিল মেরে দেয়ার দায়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দুই ভোটকেন্দ্রের চার সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রত্যাহার হওয়া প্রিসাইডিং অফিসাররা হলেন—বগুড়া জুবিলী ইন্সটিটিউশনের পূর্ব ভবনের প্রিসাইডিং অফিসার মতিউর রহমান, তিনি নামুজা ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক এবং একই প্রতিষ্ঠানের পশ্চিম ভবনের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আবু সালেহ, তিনি নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন স্কুল ও কলেজের প্রভাষক।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ প্রিসাইডিং অফিসাররা হলেন—৩ নম্বর সদর ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ কলেজের সহকারী গ্রন্থাগার মিরা শীল, উত্তর বরুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন দেব, দ্য বাডস্ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক সিরাজুন নেহার চৌধুরী এবং হাউজিং স্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার প্রসান্ত কুমার দেব।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বেলা দেড়টার দিকে তিনি এবং পুলিশ সুপারসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাসহ জুবিলী ইন্সটিটিউশন কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি ওই দুটি কেন্দ্রের বুথগুলোতে নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা সবাই একজন নির্দিষ্ট প্রার্থীর এজেন্ট। আর তাদের সবার পরিচিতিপত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরও রয়েছে।
ফেসবুকে সিল মারা ব্যালটের ছবি, আটক ১: টাঙ্গাইলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সিল মারা ব্যালটের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন অনেকে। বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে পছন্দের প্রার্থীদের খুশি করতে সিল মারা ব্যালটের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার কথা স্বীকার করেছেন কেউ কেউ। তবে ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সদর ও দেলদুয়ার উপজেলায় ভোট দেয়ার পর সিল মারা ব্যালটের ছবি অনেকের ফেসবুকে দেখা যায়।
বিষয়টি নিয়ে ভোটাররা সমালোচনা করেছেন। সিল মারা ব্যালটের ছবি পোস্ট করা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার সকালে গোপন বুথে ঢুকে তারা পছন্দের প্রার্থীদের প্রতীকে ভোট দেন। পরে নিজেদের মোবাইল দিয়ে সিল মারা ব্যালটের ছবি তোলেন। প্রার্থীকে খুশি করতে ওই ছবি নিজেদের ফেসবুকে পোস্ট করেন। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিয়ে ব্যালট হাতে নিয়ে তুলে ফেসবুকে পোস্ট করায় সোনাগাজী উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী মিশুকে আটক করা হয়েছে।
জালভোটসহ বিভিন্ন অপরাধে ছয় জনের সাজা: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল বিভিন্ন সময়ে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়। এর মধ্যে আশুগঞ্জে চারজন ও বাঞ্ছারামপুরে দুজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন সুলতানা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
জেলা প্রশাসকের মিডিয়া সেলের তথ্য অনুযায়ী, আশুগঞ্জ উপজেলার তালশহর পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিষেধ করা সত্ত্বেও মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখার দায়ে পোলিং এজেন্ট কাজী মাহবুবুর রহমানকে (৩৮) আটক করা হয়। এছাড়া উপজেলার আন্দিদিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে এসে গোপন কক্ষে ব্যালটের ছবি তোলার দায়ে তামিম সরকারকে (২৪) আটক করা হয়। পরে উভয়কে তিন দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইমরানুল হক।
একই উপজেলার তালশহর ইউনিয়নের মৈশাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার চেষ্টাকালে মো. জহুরুল ইসলাম নামে একজনকে চার দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। অনাদায়ে আরও এক দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইকরামুল হক নাহিদ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন।
এছাড়া বড়তল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ করে নিজের সিল দেয়া ব্যালটের ছবি তোলায় আমির হোসেনকে (৩৮) তিন দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
অপরদিকে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসদী ইউনিয়নের রূপসদী উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জালভোট প্রদানের চেষ্টাকালে মো. আলামিন মিয়া (৩৬) ও মো. নজরুল ইসলাম (৩৪) দুই যুবককে হাতেনাতে আটক করা হয়। পরে দুজনকে দণ্ডবিধি সাতদিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামীম এ অভিযান পরিচালনা করেন।
একাই ১৪ ব্যালটে সিল মারল যুবক: ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে এক যুবক একাই ১৪টি ব্যালট পেপারে সিল দিয়েছেন। গতকাল বিকেলে উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের সিলোনিয়া হাইস্কুল কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। বিকেল ৩টার দিকে ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সোহাগ নামে এক যুবক ভোটকেন্দ্রে ঢুকে প্রকাশ্যে সাদা চেয়ারম্যান পদের সাদা রঙের ব্যালটে সিল মারছেন। পরপর ১৪টি ব্যালট পেপারে তিনি সিল মেরে সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
টি-শার্ট ও জিন্স পরা ওই যুবক ভোটকক্ষের ভেতরে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সামনেই সিল মারতে থাকেন। এ সময় দায়িত্বরত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তাকে কিছু বলতে দেখা যায়নি। ব্যালট পেপারে সিল মারার ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত যুবক সোহাগ বলেন, আমি ভোট সম্পর্কে জানি না। সে জন্য ভুল করে এতগুলো ব্যালটে সিল দিয়েছি।
এ ব্যাপারে সিলোনিয়া হাইস্কুল কেন্দ্রে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রুমন চন্দ্র দাস বলেন, এই কেন্দ্রে ৯টি বুথে ৩ হাজার ৬০০ ভোটার রয়েছে। এ ঘটনায় সিল মারা ১৪টি ব্যালট বাতিল করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ৮৭ উপজেলার মধ্যে ১৬টিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
বাকিগুলোতে ব্যালটে ভোট দেন ভোটাররা। ইসি জানায়, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে মোট ১১২টি উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে মামলা জটিলতা ও ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ২৫ উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। সে হিসাবে আজ (বুধবার) ৮৭ উপজেলায় ভোট হয়েছে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় ধাপে মোট এক হাজার ১৫২ জন প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৯৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৫৬ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৯৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ