ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। একটানা চলা এ বৃষ্টি কখনো বাড়ছে, কখনো কিছুটা কমছে। সঙ্গে রয়েছে ঝড়ো বাতাস। ভোর থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন কর্মক্ষেত্রে যাওয়া ও খেটে খাওয়া মানুষরা এবং শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষদের সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়। তারপরেও মানুষ বৃষ্টি বিড়ম্বনার মধ্যেই ভিজে গিয়েছেন অফিসে।
সকালে কাজের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে অনেকেই রাস্তায় বাস পাননি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশাচালকরা বৃষ্টির কারণে বাড়তি ভাড়া চেয়েছেন। কোনো কোনো এলাকায় জলাবদ্ধতার শঙ্কা থাকায় অটোরিকশার চালকরা যেতে রাজি হননি। অনেকে গণপরিবহনের অপেক্ষায় থেকে বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসে ভিজে গেছেন।
গতকাল সোমবার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মধ্যে বাড্ডা, গ্রিনরোড, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ২৭, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ নম্বর, ১৪ নম্বর, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তায়, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায়, মোহাম্মদপুর, ইসিবি, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়েছেন রাজধানীতে কাজে বের হওয়া সাধারণ মানুষ। এছাড়া অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ভ্যান দিয়ে সড়ক পারাপার হতে দেখা গেছে রাজধানীবাসীকে। এছাড়া নিউমার্কেটসহ রাজধানীর আরও অনেক সড়কে জলাবদ্ধতার খবর পাওয়া গেছে।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, ভোর থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ভোর ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এভাবে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বৃষ্টি থাকবে বলে জানান তিনি।
এদিকে টানা বৃষ্টির ফলে রাজধানীতে গরম কমলেও ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। ভোর থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাজে বের হয়েছেন অনেকে। বেলা গড়িয়ে বিকাল এলেও বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
মাঝ জ্যৈষ্ঠে দিনব্যাপী এমন বৃষ্টি প্রত্যাশা করেনি রাজধানীবাসী। যদিও ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে রাজধানীতেও বৃষ্টি হবে এমনটা আগেই জানিয়েছিল আবহাওয়া অফিস। সে অনুযায়ী ভোর রাত থেকে বিরতিহীনভাবে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীতে ঝড়ছে বৃষ্টি। আর টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। ডুবে গেছে বহু সড়ক ও অলি-গলি। সেইসঙ্গে আছে গণপরিবহন সংকট। এ সুযোগে রাজধানীতে বেড়েছে রিকশা, সিএনজি ভাড়া।
একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর সব সড়কেই সব ধরনের যানবাহনসহ গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক কম। আর এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন ঢাকার রিকশা ও সিএনজি চালকরা।
এমন অভিযোগ জানিয়ে গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমার বাসা মোহাম্মদপুরে। সকালে অফিসে আসার সময় খুব ভোগান্তিতে পড়েছিলাম। বৃষ্টির কারণে অনেক রাস্তায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সড়কে বাস, গণপরিবহন কম। যে কারণে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে রিকশাচালকরা। প্রথমে বাসা থেকে বের হয়ে ডাবল ভাড়ায় রিকশায় চড়ে মোড়ে এসেছি। পরে বাস না পেয়ে ঢাকার ডুবো রাস্তায় সিএনজিতে চড়ে গুলশানের অফিসে এসেছি। সেই সিএনজি ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। সেই ভাড়া আমার কাছ থেকে নিয়েছে ৪০০ টাকা। এরচেয়ে কমে কেউ আসবে না।
সকাল থেকে ঝড়ো বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সকাল সকাল কাজে বের হওয়া রাজধানীর মানুষ। রাজধানীর কিছু কিছু সড়ক, অলিগলিতে কিছুটা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় যাতায়াত, চলাফেরা, গণপরিবহনে উঠতে ভোগান্তি; সব মিলিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে মানুষজনকে।
মুগদা থেকে সকাল নয়টায় বের হয়েছিলেন নুর আলম। গুলশান-১ নম্বরে যাওয়ার জন্য সকাল সোয়া ১০টায় রাইদা বাস থেকে লিংক রোডে নামেন। কিন্তু আসতে দেরি হওয়ায় একটি ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। নুর আলম জানান, তার অফিস সময় সকাল ১০টায়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে লিংক রোডে এসে আটকা পড়েছেন। অবশ্য কিছু সময় পরই বৈশাখী বাসে উঠে গন্তব্যে যান তিনি। গুলশানে যাওয়ার জন্য একই বাসে ওঠেন হেনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হয়ে একদিক ভালো হচ্ছে। কৃষক ফসল ফলাইতে পারছে না। সার-বিদ্যুতের দাম বেশি। তাছাড়া কয়েকদিন ধরে যে গরম এ বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি বৃষ্টি ভোগান্তিও এনেছে ঢাকাবাসীর জন্য। তারপরেও বৃষ্টি স্বস্তিই দিয়েছে।’
রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ থেকে কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল হয়ে বাড্ডা এলাকায় আসা সুজন আহমেদ নামের একজন বলেন, যে রাস্তা দিয়ে সিএনজিতে চড়ে এসেছি তার বেশিরভাগ সড়কেই জলাবদ্ধতা দেখেছি। পথে পথে মানুষের ভোগান্তি। পানির কারণে যানবাহন যাওয়ার পর ঢেউ আঁছড়ে পড়ছে সড়কে, ফুটপাতে। বাস না পেয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় সিএনজি করে আসলাম। যেহেতু মার্কেটিংয়ের চাকরি করি, তাই বৃষ্টি জলাবদ্ধতা হলেও কাজে বের হতে হয়। সে কারণেই আমরাই বুঝি বৃষ্টি, জলাবদ্ধতায় আজ কতটা বিড়াম্বনায় পড়েছেন কাজে বের হওয়া মানুষজন।
দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় মেরাদিয়া এলাকার বাসিন্দা সেফাতুল্লা সেফুর সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে তার বাড়ির সামনে হাঁটু পানি। পুরো এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্ত্রী-সন্তান কেউই বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। জরুরী কাজ থাকায় বাসা থেকে বেড় হয়েছেন। সঙ্গে ছাতা থাকলেও বৃষ্টিতে ভিজে গেছেন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালর প্রভাবে ঝোড়ো বাতাসের কারণে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় গাছও ভেঙে পড়েছে। মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায় সরকারী ডি টাইপ কোয়ার্টার এলাকায় বড় আকারের একটি কৃষ্ণচূড়াগাছ ঝড়ে ভেঙে গেছে। এ সময় ওই এলাকার চলাচলের সড়ক বন্ধ ছিল। তাছাড়া রাজধানীর উত্তরায় জসীমউদ্দীন সড়কে একটি প্রাইভেট কারের উপর একটি গাছ ভেঙে পড়ে। গাছ ভেঙে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যান চলাচলের বিঘ্ন ঘটে।
এদিকে রাজধানীর ডিএনসিসি এলাকায় কোথাও জলাবদ্ধতা হলে, পানি জমে থাকলে হটলাইনে যোগাযোগ করার (১৬১০৬) আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। একইসঙ্গে টানা বৃষ্টির কারণে যেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সে কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কুইক রেসপন্স টিম। পাশাপাশি সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ডিএনসিসি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে ডিএনসিসির আওতাধীন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন। তিনি জানান, ডিএনসিসির ১০টি কুইক রেসপন্স টিম এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। কোথাও পানি জমে থাকলে ডিএনসিসির হটলাইন ১৬১০৬ এ ফোন করুন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কুইক রেসপন্স টিম পৌঁছে যাবে। এর আগে গত রোববার জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় জরুরি নির্দেশনা দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে চলমান বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতা নিরসনে মাঠে নেমেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯১টি দল। পাশাপাশি হটলাইন চালু করেছে সংস্থাটি।
গতকাল সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র আবু নাছের বিষয়টি জানিয়েছেন।
আবু নাছের জানান, রেমাল প্রভাবজনিত বৃষ্টিপাতের ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯১টি দল মাঠে নেমেছে। প্রতি দলে ৫ জন কর্মী আছেন। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কোথাও বৃষ্টিপাতজনিত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে নগরবাসীকে ০১৭০৯৯০০৮৮৮ নম্বরে ফোন করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। হটলাইনে কল পেলে তাৎক্ষণিক সেই টিম পৌঁছে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করবে। এছাড়া অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ভ্যান দিয়ে সড়ক পারাপার হতে দেখা গেছে রাজধানীবাসীকে। নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ