২৮ অক্টোবরের ধকল যেন এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের পর মুক্তি পেয়েছেন দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু দলে সামনে থেকে সক্রিয় থাকা বেশীর ভাগ নেতা হঠাৎ করেই নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশীর ভাগ নেতা এ তালিকায় রয়েছেন। জেলা ও উপজেলাগুলোতে একই অবস্থা। দলটির অনেক নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে বহিষ্কার হয়েছেন। আবার অনেকে দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কেন্দ্রের বিরাগভাজন হচ্ছেন। তারাও রয়েছেন বহিষ্কার আতঙ্কে। এ কারণে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রের সরব নেতাদের মধ্যে নীরবতা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, জেল থেকে বের হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। যদিও দীর্ঘদিন পর গত ১০ মে রাজধানীর নয়াপল্টনে এক সমাবেশে অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন তিনি। এ ছাড়া সক্রিয় স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজপথের দলীয় কর্মসূচীতে তেমন অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এতে দলের ভিতরে তৈরী হয়েছে ক্ষুব্ধতা। হাইকমান্ডের নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদেরও দূরত্ব তৈরী হয়েছে। নির্বাচনের পর তেমন কোনো কর্মসূচী দেয়নি রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। প্রচণ্ড দাবদাহ শুরু হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ করে দলটি। এছাড়া সংবাদ সম্মেলন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে হাতেগোনা কিছু কর্মসূচী থাকলেও এতে অংশ নেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। অন্যদিকে প্রথম সারির নেতারা ঘর থেকেই বের হচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বয়কট ইস্যু নিয়ে বিএনপির ভেতরে ফাটল তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে বহুমুখী চাপে পড়েছে দলটির নীতি নির্ধারকরা। স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য ভারতের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। পক্ষে অবস্থান নেয়াদের মধ্যে রয়েছেন— দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান ও সালাউদ্দিন আহমেদ। ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, পণ্য বয়কটের কর্মসূচীতে যাওয়া বিএনপির জন্য ভুল সিদ্ধান্ত হবে বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন বিএনপির এ নেতারা।
অন্যদিকে, দলের অন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান জনগণের চাওয়া চাহিদা কী কৌশলগতভাবে দলকে সেগুলোও ভাবতে বলেছেন। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকসহ একাংশ ভারতীয় পণ্য বয়কটের সামাজিক আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়েরও ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়া অংশে সমর্থন রয়েছে। গত ২৫ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের বিষয়টি বিস্তর আলোচনা হয়। সেই বৈঠকে ভারত প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তী বৈঠকে ইস্যুতে আলোচনার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত আসেনি।
ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যুতে বিএনপি নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের যে সংকট চলছে ভারতবিরোধী ইস্যুতে তা প্রকট হয়েছে। একই সঙ্গে দলটিতে যে মতের পার্থক্য রয়েছে তাও স্পষ্ট হয়েছে। জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সম্প্রতি ভারতবিরোধিতা শুরু করার আগে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর তাগিদ ছিল বেশি। ২০২২ সালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে একান্তে আলাপ করেন বিএনপির একাধিক নেতা। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরের ১৬ মার্চে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির পাঁচ জন নেতাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েক মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দু’জন সদস্য দিল্লিতে গিয়ে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভারতের কাছাকাছি যাওয়ার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দেশটির পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে সংহতি, ধারাবাহিকভাবে দেশটির সমালোচনা করার নতুন এ অবস্থান নিয়ে স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যই স্বনামে উদ্ধৃত হতে সম্মত হননি।
সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর থেকে সরকারবিরোধী এক দফার টানা আন্দোলন করে বিএনপি। কার্যত আন্দোলনে সফলতা না আসায় অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়েছে দলটি। এমনকি আন্দোলনকে ঘিরে হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নে অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ভর করে এক ধরনের হতাশা।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাওয়া বিএনপি নেতাদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ভোটে অংশ নেয়া ইতোমধ্যে ১৪০ নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি। তৃতীয় ধাপের ভোটেও অনেক নেতা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এসব নেতার তালিকা করা হচ্ছে। ভোট বর্জনের কঠোর নির্দেশ সত্ত্বেও এমন পরিস্থিতিতে বিরক্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্বও। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দলীয় নেতাদের বহিষ্কারের তালিকা দীর্ঘ হলে সেটি তৃণমূলের সংগঠনকে আরও দুর্বল করবে— এমন পর্যালোচনা বিএনপির ভিতরেও আছে। তারপরও কঠোর অবস্থানেই থাকবে দলটি। নেতাদের ভোট থেকে বিরত রাখার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে ইতোমধ্যে সাংগঠনিক টিমকে নানা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কোনো নেতা ভোটে অংশ নেয়া বহিষ্কৃতদের কোনোভাবে সহায়তা করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। তৃণমূলের অনেকের ধারণা ছিল, জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাচনে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে দল। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা দলীয় প্রতীকে ভোট না করায় বিএনপিও নমনীয় থাকবে বলে অনেকের আশা ছিল। দলীয়ভাবে ভোটে যাওয়ার ঘোষণা না দিলেও ব্যক্তিগতভাবে কেউ প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে না— এমনটাই ধারণা করেছিলেন তারা। কিন্তু সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উপজেলা ভোটে দলের কাউকে অংশ না নেয়ার নির্দেশনা দেয় বিএনপি। বিএনপি ২০২১ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকারের কোনো কাঠামোতেই দলগত অবস্থান নেই ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির। তৃণমূলে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে এরও একটা প্রভাব রয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এ সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়। পরিস্থিতিটাকে দলের নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেন। তবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দলীয় নেতাদের বহিষ্কারের তালিকা দীর্ঘ হলে সেটি তৃণমূলের সংগঠনকে আরও দুর্বল করবে— এমন পর্যালোচনা বিএনপির ভিতরেও আছে। এর পরও কঠোর অবস্থানেই রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয় থাকার কারণ জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, এখন কি কোনো রাজনীতি আছে? একদিকে তারা (সরকার) নির্বাচন করছে, অন্যদিকে আমরা তো মাঠে রয়েছি। এ গরমের মধ্যে মাঠে নামা সম্ভব হয় না, তাই বিএনপির মাঠের কর্মসূচী খুবই কম। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তুলনামূলক মাঠে কম দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে— দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বিএনপির সব নেতাই মাঠে রয়েছেন। হয়তো প্রচণ্ড গরমের কারণে অনেকে বাইরে কম বের হচ্ছেন। এ ছাড়া গরমের কারণে এখন বিএনপির কর্মসূচীও কম দেয়া হচ্ছে।
নয়াশতাব্দী/ জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ