ঢাকা, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১০ রজব ১৪৪৬

দৃশ্যমান তবুও অদৃশ্য

প্রকাশনার সময়: ২৬ মে ২০২৪, ০৭:৫৪

চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের সঙ্গে আখতারুজ্জামান শাহীনের জড়িত থাকার বিষয়টি এখন পরিষ্কার। দেশে গ্রেপ্তার হয়েছে তিন খুনিও। তারা খুনের কথা স্বীকার করে লাশ গুমের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি খণ্ডিত লাশের একটি টুকরাও।

যদি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব না হয় তাহলে বিচারে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা আইন বিশেষজ্ঞদের। এমনকি প্রধান অভিযুক্ত পলাতক শাহীনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলে এই খুনের পেছনে আর কারা জড়িত রয়েছেন সেটিও থেকে যাবে অন্ধকারে। কারণ এ পর্যন্ত গ্রেপ্তাররা শুধু শাহীনের মিশন বাস্তবায়ন করেছে বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু খুনিরাও জানেন না শাহীনের পেছনে অন্য কেউ জড়িত আছেন কিনা। বিষয়টি স্বীকার করে গোয়েন্দারা বলছেন, ‘তারাও এখনো এই খুনের মোটিভ সম্পর্কে পরিষ্কার না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে যাচ্ছেন দেশের গোয়েন্দারা। যার নেতৃত্বে থাকছেন খোদ ডিবি প্রধান।

এ বিষয়ে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদ বলেন, মোটিভ অনেকগুলো হতে পারে। পূর্ব শত্রুতার জেরে হতে পারে, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত হতে পারে, রাজনৈতিক বিষয়ও থাকতে পারে। এসব বিষয় জানতে তদন্ত চলছে। তবে সঠিক মোটিভ এখনো পাওয়া যায়নি।

গোয়েন্দা এই কর্মকর্তার সঙ্গে একমত স্থানীয়রা, তাদের দাবি আনারকে হত্যা করার মতো সাহস কখনোই শাহীনের হবে না। কারণ আনারের কাছে শাহীন চুনোপুঁটি। এ কারণে শাহীন গ্রেপ্তার না হলে প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড কে তা নিয়ে ধূম্রজাল থেকেই যাবে বলে বলে ধারণা স্থানীয়দের। যদিও শাহীনকে গ্রেপ্তার করা অতটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কারণ এরই মধ্যে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে গেছেন।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেকের নামই পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে যশোরের সাবেক এক এমপিও রয়েছেন। তবে বেশি জোরেশোরে আলোচনায় আছেন চুয়াডাঙ্গার এক ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর নাম। কারণ তিনি ২০১৩ সালে এমপি আনারের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। সে সময় তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ হলে ২০১৬ সালে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন উভয়েই। অভিযোগ রয়েছে ওই ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর মোটা অঙ্কের টাকা মেরে দেন আনার। এটাও তদন্তে আনা হচ্ছে।স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলায় রয়েছে সীমান্তবর্তী বিশাল এলাকা।

জেলা দু’টি হচ্ছে যশোর ও ঝিনাইদহ। এই দুটি এলাকা দিয়ে সব ধরনের চোরাকারবার হয়ে থাকে। ঝিনাইদহ জেলার চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণ করতেন আনারুল আজিম আনার। এছাড়া যশোরের সীমান্তগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক এক এমপি। মূলত এই সীমান্ত এলাকায় ঘিরে গড়ে উঠেছিল সোনা ও অস্ত্র চোরাচালান এবং হন্ডি কারবারের বাড়ির বিশাল এক সাম্রাজ্য। সেখান থেকে নিয়মিত কমিশন পেতেন আনার ও যশোরের সাবেক এমপি। এই সাম্রাজ্যের অংশী ছিলেন ঢাকার মাফিয়ারাও। মূলত ঢাকার মাফিয়াদের মালামালই ওই দুই জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হতো। গত ঈদের আগে চোরাচালান সিন্ডিকেটের প্রায় ১০০ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আসে আনারের কাছে। যা তিনি আত্মসাৎ করেন। এতে আন্তদেশীয় চোরাচালান চক্রের সঙ্গে বিরোধ চরমে পৌঁছে।

স্থানীয় সূত্র মতে, এত বৃহৎ এবং সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করা একা শাহীনের পক্ষে সম্ভব নয়। শাহিনের পিছনে আরো বড় কোনো শক্তি আছে। ওই শক্তির নির্দেশ বাস্তবায়ন করে শাহীন। তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলে এই খুনের শিকড়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজনৈতিক, আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক নানা কারণে তিনি খুন হতে পারেন। তাকে হানিট্র্যাপও করা হতে পারে। আমাদের তদন্তে পর্যায়ক্রমে সব বিষয়ই আসবে। যারা সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল আমরা তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় এখনো মরদেহের অংশ বিশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যদি সম্ভব না হয় তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ একটা সময়ে বিচারে প্রধান সহায়ক হয়ে উঠতে পারে মরদেহ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রধান সহায়ক বলেও দাবি করেছেন তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা। যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তাধীন এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। এছাড়া একইভাবে এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে নাম আসা আখতারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলে ঘটনার পেছনে অন্য কোনো শক্তি আছে কিনা তাও বের করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার খুনিরা শুধু নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে শাহীনকেই চেনেন। তবে এত বড় একটি ঘটনা একা শাহীনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব না।

তদন্তে ভারত যাবে ডিবি: এদিকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারত যাবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শনিবার বা রোববারের মধ্যে মহানগর গোয়েন্দা প্রধানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম ভারত যাবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। ডিবি প্রধান জানান, ভারতীয় পুলিশ বর্তমানে এ হত্যার ঘটনা তদন্ত করছে। শনি-রোববারের মধ্যে তিনিসহ ডিবির তিন অফিসার তদন্তের কাজে ভারত যাবেন। সরকারিভাবে আদেশ (জিও) হয়েছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক নির্দেশ দিলে ভারত যাবেন তারা। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী হতে পারে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘মোটিভ অনেকগুলো হতে পারে। পূর্বশত্রুতার জেরে হতে পারে, আর্থিক লেনদেনের কারণে হতে পারে, রাজনীতিক বিষয়ও থাকতে পারে। এ সব বিষয় জানতে তদন্ত চলছে।’

‘কসাই’ জিহাদ পান পাঁচ হাজার টাকা: হত্যাকাণ্ডের হাড়হিম করা নতুন বেশ কিছু তথ্য সামনে এসেছে। কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে হত্যার পর মরদেহের চামড়া ছাড়ানো হয়। এরপর ৮০ টুকরা করা হয় তার দেহ। যাতে করে পরিচয় শনাক্ত না করা যায়। খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার ‘কসাই’ জিহাদ পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। গ্রেপ্তার জিহাদ আরও জানায়, আনোয়ারুলের দেহ ৮০ টুকরা করে নিউটাউন, ভাঙড় এলাকার নানা জায়গার জলাশয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। তার বিনিময়ে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছে সে।

খুনের তদন্তকারীরা মনে করছেন, দেহের খণ্ডাংশ জলাশয়ে ফেলে দেয়ায় তা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে গেল। ইতোমধ্যেই টুকরাগুলো পানিতে থাকা কোনো না কোনো প্রাণীর পেটে চলে গিয়ে থাকতে পারে। গত শুক্রবার ‘কসাই’ জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায়, খুনের পর আনোয়ারুলের দেহ ৮০ টুকরা করে মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মিশিয়ে দেয়া হয়। হাড়, মাংস পৃথক করে হলুদ মাখিয়ে একেকটি টুকরা একেক জায়গার জলাশয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও কোথায় কী ফেলা হয়েছে, সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে গ্রেপ্তাররা। তবে পুলিশের ধারণা, দেহাংশ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তদন্তে জানা যায়, ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্কে কিছু বিষয়ে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের ওপর ক্ষোভ ছিল তার বন্ধু ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের। ২০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে আনারকে খুন করা হয়। আগেও একাধিকবার এমপি আনারকে খুনের হুমকি দিয়েছিল শাহিন। সবশেষ গুলশান এবং কলকাতার নিউমার্কেটে দুই দফায় তৈরি করা হয় হত্যার ব্লুপ্রিন্ট। এরপর গত ১২ মে এমপি আনার কলকাতায় চিকিৎসা করাতে গেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাংয়ের সদস্য শিলাস্তির মাধ্যমে তাকে ‘হানিট্র্যাপে’ ফেলা হয়। এরপর নিউটাউনের ফ্ল্যাটে এনে ১৩ তারিখ রাতে আনারকে হত্যা করা হয়।

আড়াই কোটি টাকা পেয়েছিল ঘাতকরা: আনার অপহরণ মামলার তদারকীতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, আনার কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করতে পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি করে শাহীন। এর মধ্যে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল, জিহাদ, ফয়সালসহ অন্যদের আড়াই কোটি টাকা দিয়েছিল শাহীন। অবশিষ্ট টাকা কিলিং মিশন বাস্তবায়ন হওয়ার পর দেয়ার কথা ছিল। শাহীনের বসুন্ধরার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরিতে কাকে কত টাকা দেয়া হয়েছে তারও বিবরণ ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

আগেও দুবার খুনের পরিকল্পনা হয়: সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে এর আগে দুবার খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে এ খুনের পরিকল্পনা করা হয়। রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, দুইবারের পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের পরিকল্পনায় কলকাতায় তাঁকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর (হারুন অর রশীদ) নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল কলকাতায় যাবে। সেখানে তাঁরা এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান করবেন।

হারুন অর রশীদ বলেন, মূল পরিকল্পনা ছিল সংসদ সদস্যকে হত্যা করা। তবে এর আগে তারা (খুনিরা) চেয়েছিল কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে তাঁকে দুই দিন রেখে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা আদায় করতে। কিন্তু অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগের কারণে চেতনা না-ফেরায় আগেই সংসদ সদস্যকে খুন করা হয়। এরপর খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সংসদ সদস্যের মুঠোফোন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।

উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য গত ১২ মে আনার বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার ১৭/৩ মণ্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দা ও তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। পরে ১৩ মে দুপুরে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা কথা বলে বের হন। ওইদিন সন্ধ্যায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। পরবর্তীতে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজের অভিযোগ করেন গোপাল বিশ্বাস। ১৩ মে কোনো এক সময় নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে তাকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। ১৪ মে প্রথম পর্যায়ে এমপির মরদেহের খণ্ডিত অংশ একটি ট্রলিব্যাগে ফ্ল্যাট থেকে বের করা হলেও খুনের বিষয়টি প্রকাশ পায় ২২ মে। যদিও এখনো পর্যন্ত আনারের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

নয়াশতাব্দী/ জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ