সড়কে গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ, বাইকারদের হেলমেট না থাকলে জ্বালানি দেয়া বন্ধ, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ, ফিটনেস ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি স্ক্র্যাপ করার নির্দেশনা খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশের পরদিনই এ খাতে বেড়েছে চাঁদার হার। পেট্রল পাম্পগুলোও বন্ধ করেনি হেলমেট না থাকলে জ্বালানি দেয়া। এসব নির্দেশনার কোনোটিতেই ন্যূনতম প্রভাব পড়েনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশের। বাস্তবায়নকারী সংস্থার কাছে মন্ত্রীর এসব নির্দেশনা যেন কথার কথা যার ফলে হচ্ছে না তামিল।
সরজমিন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের মতোই রাজধানীর সড়কগুলোয় বহাল তবিয়তে ব্যাটারিচালিত রিকশা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেস ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। হেলমেট না থাকলেও মিলছে মোটর বাইকারদের জ্বালানি। সড়কে মানছে না গতিসীমার নির্দেশ।
দেশের সড়ক-মহাসড়কে গত ৫ মে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার। মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাক চলবে ৫০ কিলোমিটার গতিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। অন্যান্য যানবাহনের জন্য এই গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। গত ৫ মে ‘মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) এ নির্দেশিকা কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বিভিন্ন ধরনের সড়ক ও যানবাহনের জন্য বিভিন্ন গতির সীমা নির্ধারণকারী এই বিধিমালা প্রজ্ঞাপন হয় সেদিন থেকেই কার্যকর হবে। দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিবেচনা হলেও মহাসড়ক ও সড়কে যানবাহনের গতিসীমার কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না।
বিআরটিএর রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, যেদিন থেকে প্রজ্ঞাপন হয় সেদিন থেকেই এটি কার্যকর ধরে নেয়া হয়। তার মানে এটি অলরেডি কার্যকর হয়ে গেছে। রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক বলেন, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী সব সড়কে গাড়ির গতিসীমা বলে দেয়া হয়েছে। যারা গতিসীমা লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলেছে, দেশব্যাপী উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির ফলে সড়ক ও মহাসড়কে দ্রুতগতির যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রায়ই অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ মোটরযানের অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া মোটরযান চালানো। দ্রুতগতির কারণে আঘাতের মাত্রাও হয় অত্যধিক। ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যেই নতুন এই নির্দেশিকা জারি করা হলো বলে জানান হয়।
এদিকে গত ১৫ মে বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৭’-এর অধীনে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন থেকে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা বা গাড়ি যেন ঢাকা শহরে না চলে। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, চলতে যেন না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া ১৫ থেকেই সারা দেশে ‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। সড়কে অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বিআরটিএর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এত উন্নয়নের পরও সড়ক, মহাসড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা কেন?’ দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে এসব নির্দেশ দেন তিনি। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে অবৈধ চাঁদার হার বৃদ্ধি ছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশের কোনো প্রভাব গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া পল্টনে বায়তুল মোকাররম এলাকায় মূল সড়কে চলতে দেখা গেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। দক্ষিণখান, কাওলা, খিলক্ষেত এবং হাতিরপুল এলাকাতেও দেখা গেছে একই চিত্র। ব্যতিক্রম ছিল না নতুন বাজার থেকে বেরাইদ পর্যন্ত ১০০ ফুট মাদানি এভিনিউ।
অপরদিকে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড্ডার সিটিজেন ফিলিং স্টেশনে গিয়ে হেলমেট না থাকলেও বেশ কয়েকজন বাইকারকে জ্বালানি দিতে দেখা গেছে। একই রকমভাবে খিলক্ষেতের দুটি ফিলিং স্টেশনেও হেলমেট না থাকলেও বাইকারদের জ্বালানি দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মাথায় লাগানোর হেলমেট মোটরসাইকেলের পাশে ঝুলিয়ে মূল সড়কে চলতে দেখা গেছে অনেক বাইকারকে।
আবার ভাটারা থানার পাশের সড়কটিতে প্রতিদিনের মতো গতকালও মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে দেখা গেছে শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশা। দ্রুতগতির সড়কটিতে উল্টোপথেও অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা গেছে। রিকশার পাশাপাশি মোটরসাইকেল চালিয়ে দেখা গেছে ফাঁকা রাস্তায় রিকশাগুলোর গতি উঠছে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারের ওপরে। নতুন বাজারে ভাটারা থানার সামনের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে গিয়ে পাওয়া যায় রেকার অপারেটর এমদাদকে। ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকানোর কোনো নির্দেশনা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে আমরা আগে থেকেই এগুলোর বিরুদ্ধে তৎপর আছি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, মন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এটা রেজ্যুলেশন হবে। মন্ত্রী স্বাক্ষর করবেন। এরপর আমরা পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই নির্দেশনা পাঠাব।
এদিকে পল্টন এলাকার একাধিক রিকশাচালক জানান, রিকশা নামাতে কেউ নিষেধ করেনি; তবে রিকশার মালিক বলেছেন, আগামী মাস থেকে প্রতিদিনের জমা ৫০ টাকা বেশি দিতে হবে। রাস্তায় রিকশা নামাতে উনার নাকি এখন বেশি চাঁদা দিতে হবে। নতুন বাজার এলাকার এক রিকশাচালক জানান, তিনি এক বছর ধরে প্রতিদিন ১০০ টাকা চাঁদা দিয়ে আসছেন। তার আগে দিতেন ৬০ টাকা। গতকাল শুক্রবার থেকে চাঁদা ১২০ টাকা করা হয়েছে।
জানা গেছে, হাইকোর্ট ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার অটোরিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের পরও সড়কে নতুন করে নেমেছে কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিপুল পরিমাণ চাঁদাবাজির কারণেই রিকশাগুলো বন্ধ হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করছে। ‘আইনগত অবৈধ’ এসব অটোরিকশার মালিক-চালকদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। টাকার ভাগ যাচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং ট্রাফিক ও থানা পুলিশের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পকেটে। রাজধানীতে প্রতিটি থ্রি-হুইলার অটোরিকশার জন্য এলাকাভেদে মাসে মালিককে দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। টাকা দিলে দেয়া হয় বিশেষ টোকেন, যা থাকে সিটের নিচে। ওই টোকেন থাকলেই সড়কে চলার অনুমতি মেলে। কিছু এলাকায় কিউআর কোড ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। মোবাইলে কোড স্ক্যান করলেই জানা যায় তার চাঁদা পরিশোধের হালনাগাদ তথ্য।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ