জামিনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন এক সময়ে আলোচিত মামলার আসামিরা। তারা নিম্ন আদালতে ব্যর্থ হয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে ঘুরছেন। কেউ এক বেঞ্চে শুনানি খারিজ হওয়ায় ছুটছেন আরেক বেঞ্চে। এর মধ্যে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের জামিন শুনানিতে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেছেন আপিল বিভাগ। তারপরও থেমে নেই তাদের দৌড়ঝাঁপ। সুবিধা পেতে নাম করা ব্যারিস্টার-উকিলের শরণাপন্ন হচ্ছেন অনেকে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কঠোর অবস্থানের কারণে সহসাই তাদের জামিন মিলছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে যেন চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর মামলার আসামিরা জামিনে বের হতে না পারেন সে বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করি সরকারের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরার। মামলার বিষয়বস্তু ও সঠিক তথ্য আদালতের সামনে তুলে ধরি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা আদালতকে ভুল বুঝিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা যেন জামিন না পান সে বিষয়ে আমরা সতর্ক ও তৎপর রয়েছি।’
আদালতের সূত্রমতে, একের পর এক জামিন আবেদন করে যাচ্ছেন আলোচিত মিতু হত্যা মামলার আসামি সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। বসে নেই রানা প্লাজা ধস ও হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানাও। প্রতারণা মামলার আসামি মোহাম্মদ সাহেদও ঘুরছেন উচ্চ আদালতে। এছাড়া জামিন প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিও। এছাড়া তালিকায় রয়েছে বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী ও স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত ব্যক্তিরাও।
আদালতের একটি সূত্রমতে, চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি, বিশেষ করে বড় বড় মাদক কারবারি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার জন্য খুবই তৎপর থাকে। কারণ, এসব অপরাধীর একটা অর্থনৈতিক শক্তি থাকে। সে কারণে তারা বারবার আদালতে আসে এবং জামিন পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এসব অপরাধী অনেক সময় বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে। আবার অনেক সময় দেখা যায় এমন সব আইনজীবী নিয়োগ করে তারা আদালতকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করে। তবে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ অত্যন্ত তৎপর ও সচেতন থাকায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
জানা গেছে, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জি কে শামীম সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। দ্রুত জামিন পেতে তার আইনজীবীরা প্রতারণারও আশ্রয় নিয়েছেন। গত ২৯ এপ্রিল জি কে শামীমের জামিন ঘিরে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় আইনজীবী নিখিল কুমার সাহাকে এক সপ্তাহ মামলা পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে অর্থপাচারের মামলায় জি কে শামীমের জামিন আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন আদালত। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আট বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের মামলায় ঢাকার একটি আদালত জি কে শামীমকে গত বছরের ১৭ জুলাই ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন জি কে শামীম। পাশাপাশি তিনি জামিন আবেদন করেন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন। কিন্তু জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে চেম্বার আদালত তা স্থগিত করে দেন। ‘পরে জি কে শামীমের আইনজীবী নিখিল কুমার সাহা জামিনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আপিল বিভাগে মেনশন স্লিপ জমা দেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে জি কে শামীমের মামলাটি কার্যতালিকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন আপিল বিভাগে কার্যতালিকায় দেখা যায় মামলাটি সরাসরি আদেশের জন্য ৪ নম্বর ক্রমিকে এসেছে।
মামলাটি শুনানির জন্য এলে অস্বাভাবিকভাবে কার্যতালিকায় আদেশের জন্য থাকার বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আসে। এ সময় আদালত আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করেন। তাকে আপিল বিভাগে এক সপ্তাহ মামলা পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন।’
হাইকোর্টের এক বেঞ্চে জামিন না পেয়ে আরেক বেঞ্চে ছুটছেন স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার আসামি সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। দেশের নামকরা আইনজীবীরা তার পক্ষে মামলায় লড়ছেন। সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারের জামিন আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চসহ একাধিক বেঞ্চে জামিন আবেদন করে ব্যর্থ হন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার।
রানা প্লাজা ধসে পড়ে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ভবনটির মালিক সোহেল রানার জামিন আবেদন শুনানি এখনো আপিল বিভাগে মুলতবি রয়েছে। গত বছর হাইকোর্ট সোহেল রানাকে জামিন দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। এরপর আপিল বিভাগ একাধিকবার সোহেল রানার জামিন শুনানি ‘স্ট্যান্ড ওভার’ রাখেন। জানা যায়, সোহেল রানার আইনজীবীরা জামিন শুনানি দ্রুত করতে তৎপর রয়েছেন। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর থেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তিনি হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চে জামিন আবেদন করেছেন।
সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে আবারও জামিন আবেদন করেন তিনি। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বী আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজোয়ান আলী খাঁন হূদয় ওরফে টিকটক হূদয়, মো. হাসান ও আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। একইভাবে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেতে তৎপর রয়েছেন। এর মধ্যে একাধিক মামলায় মো. সাহেদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে, আপিল বিভাগ তার জামিন আটকে দিয়েছেন।
সমপ্রতি অস্ত্র মামলায় সাহেদকে বিচারিক আদালতের দেয়া যাবজ্জীবন দণ্ড থেকে খালাসের রায় স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ আদালত। মামলায় সাহেদকে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় যাবজ্জীবন ও ১৯ (চ) ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুটি সাজা একত্রে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অস্ত্র বাজেয়াপ্ত এবং যে গাড়ি থেকে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়, তার মালিকানা যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করেন সাহেদ। এর আগে ওই বছরের ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। পরদিন ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাহেদসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।
জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও বহিষ্কৃত ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। হাইকোর্টের এক বেঞ্চে জামিন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ছুটছেন আরেক বেঞ্চে।
সর্বশেষ বাবুকে জামিন না দিয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ ছাড়া রাজধানীর মতিঝিলে যুবলীগ নেতা টিপু ও প্রীতি হত্যা মামলার আসামিরা, বিভিন্ন জেলার ধর্ষণ মামলার আসামিরা এবং সারা দেশের আরও অনেক আলোচিত মামলার আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাদের জন্য আদালতে দাঁড়াচ্ছেন নাম করা আইনজীবীরা।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ