১২৪০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে নিটল মটরসের বিরুদ্ধে। কোম্পানিটি এই ভ্যাট ফাঁকি দিতে বিক্রয়ের তথ্য গোপন করেছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে ১৬ হাজার ১৪৮টি যানবাহনের তথ্য প্রদর্শন করেনি কোম্পানিটি। ফলে এসব গাড়ির ভ্যাটও পরিশোধ করা হয়নি।
এনবিআরের নথিপত্র ও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, নিটল মটরস লিমিটেড ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ক্রয় করা গাড়ির মধ্যে মাত্র ১৩৬৮টির তথ্য ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি করেছে। এ সময়ে ক্রয়-বিক্রয় করা আরও ১৬ হাজার ১৪৮টি যানবাহনের তথ্য প্রদর্শন করেনি তারা। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তারা কেনাবেচা করে ১১ হাজার ৯৪৯টি যানবাহন। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ক্রয়-বিক্রয় করে চার হাজার ১৯৯টি যানবাহন।
তবে এ বিক্রয়ের ওপর কোনো মূসক পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে অপ্রদর্শিত বিক্রয়ের ওপর ২৭০ কোটি ৭৯ লাখ ৬৮৭ টাকা মূসক দাবি করে এনবিআর। এছাড়া পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি ৯৬৯ কোটি ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩৩ টাকা ফাঁকি দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। যশোর কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট প্রথম বিষয়টি বুঝতে পারে। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে একটি শুনানি হয়।
বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ফাঁকি: নিটল মটরস লিমিটেড ‘ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিকেল’ খাতের আয়কে পণ্য পরিবহন সেবা হিসেবে চিহ্নিত করে ওই খাতের আয় মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর দ্বিতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ ৫(খ) অনুসারে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু ভ্যাট নিরীক্ষা টিম মনে করে, পরিবহন সেবা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নামে রেজিস্ট্রিকৃত যানবাহনসমূহ দ্বারা সরাসরি (মূসক অব্যাহতিপ্রাপ্ত) পণ্য পরিবহন সেবা প্রদানের প্রমাণক দেখাতে পারেনি।
মূসক দলিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভারতের নীতা কোম্পানি লিমিটেড তাদের বিক্রয় করা পণ্যের কিছু অংশ নিটল মটরস লিমিটেডের কাছে সরাসরি মূসক-১১ চালানপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করেছে। অবশিষ্ট পণ্য বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রয় প্রদর্শন করা হয়েছে। ব্যাংকের কাছে বিক্রয় প্রদর্শন করলেও ঠিকানা হিসেবে নিটল মটরসের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। নিটল মটরসের নামে যত চালান (মূসক-১১) নীতা কোম্পানি ইস্যু করেছে শুধু সেই পরিমাণ পণ্যই ক্রয় খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ পণ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংকের নামে চালানপত্র ইস্যু করে নিটল মটরস লিমিটেড হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে, সেই পরিমাণ পণ্য নিটল মটরসের ক্রয় রেজিস্টার বা বিক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, পরিবহন ঠিকাদারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘পরিবহন ঠিকাদার অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যিনি বা যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), ব্যাংক, বিমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লিমিটেড কোম্পানি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, তালিকাভুক্ত হোক বা না হোক, পণ্যের বিনিময়ে যে কোনো পণ্য পরিবহন করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন।’
কিন্তু নিটল মটরস পণ্য পরিবহনের কাজ করে না। প্রতিষ্ঠানটি অন্য প্রতিষ্ঠানের অর্থের বিনিময়ে যানবাহন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে। এক্ষেত্রে পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকে। কাজেই এরূপ কার্যক্রম অনুযায়ী তাদের পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে গণ্য করা যায় না।
ওই আদেশ অনুযায়ী মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর ধারা ১৪ অনুযায়ী অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ ‘বিবিধ সেবা’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দুটি দাবিনামার বিপরীতে ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভিহিকেলস খাতে ৯৬৯ কোটি ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩৩ টাকা মূসক দাবি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিকেলস খাত এবং মূসক দলিলাদিতে অপ্রদর্শিত বিক্রয়ের ওপর পরিহার করা ভ্যাটসহ মোট এক হাজার ২৩৯ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার ২০ টাকা ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে মনে করছে ভ্যাট বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন বলেন, নিটল মটরস লিমিটেডের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিকেলস’ খাতে প্রদর্শিত আয়ের বিপরীতে মূসক/ভ্যাট নিরূপণকালে নিরীক্ষা দল কোম্পানির খতিয়ান বহি., পণ্য ও সেবা ক্রয়ের তালিকা, ক্রেতার সহিত চুক্তিপত্র, অপারেটিং লিজ বা রেন্টাল ইনকাম সংক্রান্ত নমুনা বিলের কপি দাখিল করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও প্রতিষ্ঠানটি কোনো দলিল দাখিল করেনি। এ ছাড়া প্রদর্শিত আয়ের বিপরীতে কোনো মূসক-১১ চালানপত্র ও বিক্রয় হিসাব রেজিস্টার উপস্থাপন করেনি। আমরা আমাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির যে কথা বলা হচ্ছে, তার মানে হলো আপনি ভোক্তার কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স নিচ্ছেন, কিন্তু তা পরিশোধ করছেন না। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অগোচরে এটা সম্ভব না। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কেউ না কেউ জড়িত থাকে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যিনি বা যারা মনিটরিং করেন, তাদের পক্ষ থেকে তৎপর হতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মনিটরিংয়ের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারাই সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতিই দিচ্ছেন না। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যাটি চিহ্নিত করা এবং স্বীকৃতি দেয়া, এরপর এ সমস্যার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে তার আলোকে পদক্ষেপ নেয়া। সামপ্রতিক সময়ে বাজেট পূর্ব বিভিন্ন আলোচনায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার কথা উঠে এসেছে। কিন্তু যাদের এ সমস্যা সমাধানের কথা, তারা এগুলোকে সমস্যা মনে করছেন না।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ