ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানা কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। রিখটার স্কেলে আট মাত্রা বা তার চেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা। মুহূর্তেই ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, প্রানহানি ঘটতে পারে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। এমন বাস্তবতার মধ্যেও ভূমিকম্প বা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় তেমন কোনো প্রস্তুতিও নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণের। জরুরি অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কিছুই দিতে পারবে না তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো এমন ভয়াবহ দুর্যোগে সৃষ্টিকর্তার ওপরই ভরসা। ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকা বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ভূতত্ত্ববিদরা আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আট মাত্রা বা তার চেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে রকম ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ছয় হাজারেরও বেশি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণহানি হতে পারে অন্তত তিন লাখ মানুষের-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নুরুজ্জামান খান এ ব্যাপারে বলেন, বড় দুর্যোগে বা জরুরি অবস্থাকালে কী কাজ তা আমরা নির্ধারণ করেছি। এটা একটা বিশাল ব্যাপার। মোকাবিলা করা অনেকটাই অসম্ভব। বড় বড় দেশও এমন দুর্যোগ তেমন মোকাবিলা করতে পারছে না। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে তা দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে বড় বড় টাওয়ার রয়েছে তার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করা যাবে দুর্যোগকালে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, শুধু বুদ্ধি দিয়ে দুর্যোগে কুলিয়ে উঠা যাবে না। আল্লাহ যদি রক্ষা করেন, তাহলেই রক্ষা। বিজ্ঞানের কোনো সূত্রই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারছে না।
ভূমিকম্পের আগে তেমন কিছুই করার থাকে না জানিয়ে ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন আগে মিরপুর এলাকার একটা ১২ তলা ভবন কাত হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারীরা সাত দিন টানাটানি করে পরবর্তীতে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। খোলা জায়গায় একটা ভবন কাত হয়ে যাওয়ার পর এ অবস্থা। আমাদের ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার এমন অবস্থা যেখান থেকে লাশ বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। আগে সক্ষমতা ছিল না, এখন কিছুটা বেড়েছে। এ সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি রোধে প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নগরের সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। ভবন নির্মাণে সাবধানতা অবলম্বন করলে ভূমিকম্পে ক্ষতি কমানো সম্ভব। প্রয়োজন সরকারের সব সংস্থার নজরদারি আরও জোরদার করা এবং ভূমিকম্পের ওপর প্রশিক্ষণে জোর দেয়া।
সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে সামনে এনে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভবনগুলোর অভ্যন্তরীণ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাহীন দুর্বলতা ও নগর সংস্থাগুলোর সার্বিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, নজরদারি ও আইনের প্রয়োগের দুর্বলতার সামনে এসেছে। অগ্নিকাণ্ডসহ অতীতের নগর দুর্যোগের ফলে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর সুপারিশ আমরা কেন বাস্তবায়ন করতে পারিনি, সেই বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফায়ার সংক্রান্ত দেশের বিদ্যমান আইনে সাততলা ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০-এ ১০ তলা ভবনকে বহুতল হিসেবে বিবেচনা করার ফলে সাততলার উপর অনেক ভবনেই অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিআইপির সভাপতি বলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য কেমিক্যাল পল্লী স্থাপন প্রকল্পের আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রকল্পের উন্নয়নকৃত ভূমিতে অতিবিপজ্জনক রাসায়নিক গুদাম সরানোর ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। একই সঙ্গে সারা দেশের ভবন নির্মাণে যথাযথ মানদণ্ড ও অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি অনতিবিলম্বে গঠন করে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ২০১৫ সালে আরবান রিজিলিয়েন্স নামক প্রকল্প নেয় সরকার। ৮১৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় দুই সিটি করপোরেশনে দুটি ইওসি (ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার) স্থাপনের কাজ করে। এছাড়া আটটি জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ওয়্যারহাউজ রয়েছে এ প্রকল্পে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি ইওসিতে আছে ডেটা সেন্টার, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি, যা ব্যবহার করে ঘরে বসে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম তদারক করা যাবে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজে থাকবে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য বিদ্যুৎচালিত হাতুড়ি, পাথর কাটার যন্ত্র, অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রসহ ৫৩ ধরনের যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া ওয়্যারহাউজেই থাকবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, যা যুক্ত থাকবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে। আর এখানেই হবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ।
গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আপৎকালীন জরুরি সাড়াদানসহ উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
ডিএনসিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জনবল ও পরিচালন নীতিমালার অভাবে অনেকটাই অকার্যকর এ প্রকল্প। নিরাপত্তা ও প্রস্তুতি, নিরাপত্তা পরিকল্পনা, সমন্বয়, সরঞ্জাম ও পরিচালনা, তথ্য ও প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, জনসংযোগ, অর্থ ইত্যাদি খাতে জনবল আরও প্রয়োজন। কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী সংকটও তীব্র। তবে উত্তরের মতো প্রাথমিক সেবাটুকুও দিতে তেমন সক্ষম নয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ইওসি (ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার)।
অন্যদিকে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দুই সিটি করপোরেশনের ওয়্যারহাউজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে গিঞ্জি এলাকায়। যেখান থেকে জরুরি সেবা দেয়া অনেকটা অসম্ভব। এরই মধ্যে কোনো কোনো ওয়্যারহাউজ থেকে সরঞ্জাম চুরির ঘটনাও ঘটেছে। তালতলা ওয়্যারহাউজটি নির্মাণ করা হয়েছে তালতলা কবরস্থানের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে ডানদিকে একটি সরু রাস্তায়। যেখানে একাধিক লোক হেঁটে চলাচল করাও দায়। সায়েদাবাদ ওয়্যারহাউজ বাসস্ট্যান্ডের সামনে। কারওয়ান বাজারেরটি ঘিঞ্জি এলাকায়। অথচ এসব ওয়্যারহাউজ থেকে জরুরি অবস্থায় সরঞ্জাম বের করার সুব্যবস্থা নিশ্চিতসহ অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ি প্রবেশ বা বের হওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। এছাড়া ওয়্যারহাউজগুলোতে নেই প্রশিক্ষণ নেয়ার উপযুক্ত জায়গা।
এ বিষয়ে আরবান রিজিলিয়েন্স প্রজেক্ট পার্টের প্রকল্প পরিচালক ও ডিএনসিসির প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, আমাদের কার্যক্রম চলমান। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইওসি আমরা নির্মাণ করে দিচ্ছি। দুর্যোগের সময় তথ্য যোগাযোগে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের ইওসির মাধ্যমে মেয়র বা যারা এটার সঙ্গে যুক্ত তারা তদারক করতে পারবেন।
ওয়্যারহাউজগুলোর কাজ নিয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক ওয়্যারহাউজ করা হয়েছে। সেগুলোতে কিছু সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। এগুলো মূলত ‘প্রাথমিক সহায়তা’ দিতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে সেখানে একটা করাত, শাবলের মতো সরঞ্জাম আছে, যেগুলো দিয়ে প্রাথমিক সহায়তা দেয়া যাবে। ওয়ার্ডভিত্তিক কাজ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শুনেছি ওয়ার্ডভিত্তিক একটা কমিটি করা হয়েছে অনেক আগে। আমি আসার আগে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের একটি প্রতিবেদনে ভূমিকম্প বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে বলা হয়, রিখটার স্কেলে যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা। ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। উল্লেখ্য, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, নাটোর, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৬ মিনিটের দিকে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫। এর উৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারইপাড়া। এর আগে গত ২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল পাঁচ দশমিক ছয়। তারও আগে গত ২ অক্টোবর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলের ৫ দশমিক ২। এর উৎসস্থল ভারতের মেঘালয় রাজ্য।
এছাড়া ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল সকাল ৫টা ৫৭ মিনিটে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে রাজধানী। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নগরবাসী। এর আগে ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই ৬ জনের মৃত্যু হয়। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪৫ বার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ, এমনটাই জানা গেছে।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ