ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

মানি এক্সচেঞ্জের গ্রাহক-হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ছিনতাই টার্গেটে

প্রকাশনার সময়: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:৩০
ফাইল ছবি

ছিনতাইকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন মানি এক্সচেঞ্জের গ্রাহকরা। মোটা অঙ্কের টাকা তুলে বের হওয়ার পরই তা অস্ত্রের মুখে লুট করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুলির ঘটনাও ঘটছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরাও তাদের মূল টার্গেটে রয়েছেন।

গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যে একথা জানা গেছে। তাদের মতে, এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী। তারাই ছিনতাকারীদের আগাম তথ্য দিয়ে থাকেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা নিজেরাই রেকি করে ছিনতাই ঘটিয়ে থাকেন। ছিনতাই করা টাকায় আবার অনেকে গড়ে তুলেছেন মাছের খামার ও গরুর ফার্ম। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সর্বশেষ বুধবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় কোটি টাকা লুটের দুটি ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। উদ্ধার করা হয় দুটি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও ৫০ রাউন্ড গুলি। ছিনতাইকাজে ব্যবহার করার জন্যই ১২ লাখ টাকা দিয়ে তারা অস্ত্র দুটি সংগ্রহ করেছে বলে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে। এর আগে প্রবাসীর টাকা লুটের ঘটনার গ্রেফতার করা হয় এক সাব ইন্সপেক্টরসহ আরো ৬ ডাকাতকে। গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যমতে, চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার পর সরকার অনুমোদিত ২৩৪টি মানি এক্সচেঞ্জের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য সরেজমিন তদন্ত শুরু করা হয়। এরপর অনেক এক্সচেঞ্জকে আগের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। আবার অনেকে স্থান বদল করলেও তা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি নেয়নি। আবার সরকারের অনুমতি না নিয়েও গড়ে তোলা হয়েছে মানি এক্সচেঞ্জ। এ কারণে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো ঠিকানা নেই। ফলে ওই সব এলাকায় পুলিশি তৎপরতা শুরু করা যাচ্ছে না। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় কোটি টাকা লুটের দুটি ঘটনায় গত বুধবার গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, জালিল মোল্লা, রিয়াজ ও দীপু। তাদের কাছ থেকে দু’টি বিদেশি রিভলবার, ৫০ রাউন্ড গুলি, দু’টি মোটরসাইকেল ও লুট করা ১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ডাকাতির জন্য তারা সরকারি ছুটির দিন শনিবারকে বেছে নিতেন। টার্গেট করতেন মানি এক্সচেঞ্জকে। তারা সবাই পেশাদার ডাকাত দলের সদস্য। এই দলের একটি গ্রুপ মানি এক্সচেঞ্জ এলাকায় অবস্থান করে ও যারা বেশি টাকা বহন করে তাদের টার্গেট করে। মানি এক্সচেঞ্জার থেকে টাকা নিয়ে কেউ বের হলে সেই তথ্য তারা তাদের সহযোগী মোটরসাইকেলে অবস্থানকারী গ্রুপকে দেয়। এরপর সুবিধাজনক স্থানে ফাঁকা গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

জানা গেছে, গত ২৮ আগস্ট একজন ব্যবসায়ী মতিঝিলের নিহন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ৬০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িযোগে রওনা দেন। ছয়জন ডাকাত মোটরসাইকেলযোগে ওই ব্যবসায়ীর গাড়ি অনুসরণ করে দুপুর ১টা ২০ মিনিটে মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপর গাড়িটির গতিরোধ করে। ডাকাতরা আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে এবং হাতুড়ি দিয়ে গাড়ির দরজার গ্লাস ভেঙে ফেলে। তারপর ওই গাড়ি থেকে ৬০ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ২৯ আগস্ট রমনা মডেল থানায় একটি মামলা হয়। এছাড়াও ৪ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক ব্যবসায়ীকে আক্রমণ করে এই ডাকাত দলের সদস্যরা। ওই ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় পৌঁছালে ডাকাত দলের সদস্যরা তার গতিরোধ করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। পথচারীরা জড়ো হয়ে ডাকাতদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে ডাকাতরা গুলি ছোড়ে। এতে একজন পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়। এই ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। চাঞ্চল্যকর এই দু’টি ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবির রমনা বিভাগের টিম। এক পর্যায়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার জলিলের বিরুদ্ধে চারটি ও বাকি দু’জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মিশু বিশ^াস বলেন, গ্রেফতারকৃতরা সবাই পেশাদার অপরাধী। এর আগে তারা গাজীপুরে একটি গার্মেন্টের ৮৫ লাখ টাকা লুট করে। ওই ঘটনায় তারা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়ে ১২ লাখ টাকায় দুটি অত্যাধুনিক জার্মানির তৈরি অস্ত্র কেনে। এরপর ওই অস্ত্র দিয়ে তারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় কোটি টাকার দুটি লুটের ঘটনা ঘটায়। লুট করা টাকা দিয়ে তারা যশোরে মাছের খামার ও গরুর ফার্ম গড়ে তোলেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার কাজী শফিকুল আলম বলেন, ২০২০ সালের শেষের দিকে বিমানবনন্দর এলাকায় যাওয়ার পথে এক প্রবাসীর টাকা পয়সা লুট হয়। ওই মামলার তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ। এক পর্যায়ে ওই মামলার ৬ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিরা হচ্ছেন আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া, হাসন রাজা, মোশরফ হোসেন, সেলিম মোল্লা, ও মো. রিপন মোড়ল। তাদের মধ্যে হাসান রাজা ও সেলিম মোল্লার নামে ৩টি করে বিমানবন্দর, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও মাদারীপুরে ডাকাতি মামলা রয়েছে। আসামিদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সাবেক সেনা সদস্য হাসন রাজা। ওই জবানবন্দিতে সিআইডির এসআই আকসাদুজ্জামানকে সাময়িক সাসপেন্ড করে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনার পর আকসাদুজ্জামান ও সোর্স আমিরের একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায় তারা হুন্ডির টাকা ডাকাতির পরিকল্পনা করছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরাইয়েশী বলেন, গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুবাই যাওয়ার জন্য টিকাটুলির বাসা থেকে থেকে সিএনজি অটোরিকশা যোগে বের হন রোমান মিয়া নামে এক প্রবাসী। তার সিএনজি অটোরিকশাটি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিমানবন্দরসংলগ্ন কাওলা ফুটওভারব্রিজের কাছে পৌঁছালে একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেল তাদের গতিরোধ করে। এরপর ডিবি পরিচয়ে রোমান মিয়াকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। এবং মনির হোসেনকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। পরে রোমানকে গাড়ির ভেতর মারধর করে আনুমানিক ৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা মূল্যের ইউএস ডলার, দিরহাম ও মোবাইল ফোন লুটে নেয়া হয়।

তিনি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায় একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ঘটনার এক দিন আগে টাকাকে রূপান্তর করেন রোমান মিয়া। সেখান থেকে সোর্সের মাধ্যমে বিদেশে ডলার ও দিরহামের বিষয়ে তথ্য পায় আকসাদুজ্জামানের সিন্ডিকেট। এরপর তারা লুট করেন।

শুধু রোমান মিয়ার টাকাই নয়, এর আগে তারা আরো একাধিক হুন্ডি ব্যবসায়ীর টাকা লুট করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ডলার ভাঙালে তার তথ্যও পেয়ে যায় ছিনতাকারীরা। এজন্য মানি এক্সচেঞ্জে তাদের নিজস্ব সোর্স রয়েছে। লুট হওয়া টাকার একটি অংশ পায় সোর্সরাও। গ্রেফতার আমিরসহ অনেকে এই টাকায় গরুর ফার্ম ও মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। মানি এক্সচেঞ্জের এই চক্রের একাধিক সদস্য গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। দ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ