ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তৃণমূলে নেতৃত্ব শূন্যের শঙ্কা

প্রকাশনার সময়: ০৮ মে ২০২৪, ০৮:১২

জাতীয় সংসদের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি। কিন্তু তারপরও দলটির তৃণমূলের কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বহিষ্কারের মতো কঠোর সাংগঠনিক শাস্তির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও নির্বাচন থেকে তাদের ফেরানো যাচ্ছে না। দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ১৪৪ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ৩০০ নেতা বহিষ্কার হতে পারে। এভাবে গণহারে বহিষ্কার করা হলে বিএনপির তৃণমূলে নেতৃত্ব শূন্যের শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও এ নিয়ে কেন্দ্রের মাথাব্যথা নেই। কারণ বিএনপির মতো একটি বড় দল থেকে এমন সংখ্যক নেতা হারিয়ে গেলে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দলের চেইন অব কমান্ড ফিরে আসবে।

জানা গেছে, বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে। এতে করে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ কারণে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অনেকেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা এলাকাকেন্দ্রিক বিবেচনায় উপজেলা নির্বাচনে নেমে পড়েছেন। কেউ কেউ নিজে প্রার্থী হয়েছেন, অনেকে অন্য প্রার্থীর পক্ষে ভোটের মাঠে রাখছেন সক্রিয় ভূমিকা। অন্যদিকে ভোটে অংশ নেয়া নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করছে বিএনপি। এ নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের দূরত্ব ও অসন্তোষ দিন দিন বেড়েই চলছে। বিএনপি সূত্র জানায়, ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো হওয়ার কথা থাকলেও বলতে গেলে তেমন তৎপরতা নেই বিএনপির। এখন সব ধরনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মিশন হিসেবে নিয়েছে দলটি। সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সমর্থনে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রার্থীদের নির্বাচনবিমুখ করতে কেন্দ্রীয়, বিভাগীয় ও জেলার নেতাদের বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এত করে কার্যত কোন সফলতা আসছে না। খুব কমসংখ্যক প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে ফেরাতে সক্ষম হচ্ছে। যেসব নেতা প্রার্থী হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ভোটের মাঠে থেকে যাচ্ছেন। এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির তৃণমূলের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে দলের হাইকমান্ড। এ কারণে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তৈরি হয়েছে ক্ষুব্ধতা। হাইকমান্ডের নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও শেষ ধাপে এসে সঠিক নির্দেশনা পায়নি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হবে সভা সমাবেশে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। কিন্তু নেতাদের আটকের পর আন্দোলনের বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা দেয়া হয়নি তৃণমূলকে। এছাড়া আন্দোলনের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তার ছিটেেঁফাটাও জোটেনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাগ্যে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বিএনপির বেশির ভাগ নেতা ভোটের মাঠে থাকবেন। তাদের মতে, এবার উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তাই তারাও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, রাজনীতি হচ্ছে জনগণের জন্য। আর জনগণের জন্য কাজ করতে ভোটে অংশগ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই।

জানা গেছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন করেছে বিএনপি। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে নানা কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এর মধ্যে একাধিকবার দলটির কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। ওই সময় অনেক হামলা, বাধা, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দলটি সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বড় সমাবেশ সফলভাবে সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয় নেতাকর্মীরা। সারা দেশে সফলভাবে পালন করতে পারলেও প্রথম ধাক্কা আসে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি সমাবেশে করার জেদ ধরে বিএনপি।

এরপর ফের ঘুরে দাঁড়াতে নতুনভাবে সারা দেশে কর্মসূচি চালিয়ে যায় বিএনপি। ২০২৩ সাল ২৮ জুলাই রাজধানীতে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সারা দেশ থেকে কয়েক লাখ নেতাকর্মী মহাসমাবেশে অংশ নেয়। এসব নেতাকর্মীদের ঢাকা ত্যাগ না করার জন্য বলা হয়। ওই মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু সেই কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাড়া কেন্দ্রে কোনো নেতার উপস্থিতি দেখা যায়নি। দেখা দেয় দলের মধ্যে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা। যার কারণে আগের দিন মহাসমাবেশে লাখো মানুষের জমায়েত হলেও পরদিনের অবস্থান কর্মসূচিতে কয়েক হাজার নেতাকর্মীও উপস্থিত করতে পারেনি বিএনপি।

সূত্র জানায়, গত ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশ মুখে অবস্থান ব্যর্থ হওয়ার পর ফের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগে তিন মাস। এরপর আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে এসে ২৮ অক্টোবর আবার ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয় দলটি। কিন্তু সংঘাত ও সহিংসতায় পড়ে সেই মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে পণ্ড হয়ে যায়। আন্দোলনের নামে সহিংসতা কিংবা হেফাজত ইসলামের মতো তাণ্ডব করলে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতকে যেভাবে দমন করা হয়েছে, বিএনপিকে সেভাবে দমন করা হবে; ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা এমন বক্তব্য দিলেও মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না বিএনপির। এরপর এ সংঘাতকে কেন্দ্র করে দলের মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা একের পর এক আটক করা হয়। অন্য নেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে চলে যায় আত্মগোপনে। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা প্রার্থী হয়েছে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তৃণমূলে বিএনপির নেতৃত্ব সংকট হবে এটা বড় কথা নয়। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তারা দলের ১০ শতাংশেরও কম। এ বহিষ্কারে দলের মধ্যে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না; কারণ তারা সেই পর্যায়ের নেতা নয়। এক সময় যারা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ছিল তারাই এখন প্রার্থী হয়েছে। এত তৃণমূলের ক্ষতি হবে বা নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যাবে এটা ভাবার কারণ নেই। বিএনপির তৃণমূল নেতাদের যেভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে এতে নেতৃত্ব সংকটের শঙ্কা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সংকটের কোনো সম্ভবনা নেই। যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে তাদের বহিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে এ ধরনের নেতা তৃণমূলে অনেক রয়েছে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ