দেশে রেলওয়ের উন্নয়নে একাধিক নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সংস্কার হচ্ছে না পুরোনো রেললাইন ও সেতু। এসব জরাজীর্ণ রেললাইন ও সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই চলছে ট্রেন, প্রতিদিন যাতায়াত করছে হাজার হাজার মানুষ।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মানসম্পন্ন মাত্র ১ হাজার কিলোমিটার। এসব রেললাইনের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-জয়দেবপুর এবং যশোর-আব্দুলপুর রেললাইন ডাবল রেললাইন। বাকি রেললাইন সিংগেল রেললাইন এবং বেশির ভাগই জরাজীর্ণ। তাই প্রতিনিয়ত লাইনচ্যুতিসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির প্রায় ৬৩ শতাংশই হয় ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও দুর্বল সেতুর কারণে। গত পাঁচ বছরে ২ হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে দেড় শতাধিক যাত্রী ও পঙ্গু হয়েছে ৫০০ যাত্রী। এর মধ্যে গত চার মাসে সারা দেশে রেল দুর্ঘটনা ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ১৬০টি। এসব ঘটনায় ১৮ জন যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় ২০০ যাত্রী।
গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে ৩১৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ১৪৩টি ট্রেন বিগত ১৫ বছরে চালু করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন মেরামত করা হয়েছে। ১৪৬টি নতুন রেলস্টেশনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২৭৩টি স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ, ১ হাজার ৩৭টি নতুন সেতু নির্মাণ, ৭৯৪টি রেলসেতু পুনর্নির্মাণ, ১০৯টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৫৩০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন ইত্যাদি। রেলে বর্তমানে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮, যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ। আর সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫, যার ৬০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। রেলওয়েতে ৪৭ হাজার ৬০০ জনবলের বিপরীতে মাত্র ২৪ হাজার জনবল রয়েছে। বেসরকারি তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন রয়েছে। এর মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র ১ হাজার কিলোমিটার। সিগন্যালিং ত্রুটি, ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ কোচ সংযোজন, জরাজীর্ণ রেললাইন, রেললাইন পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব ও জনবল অভাবের কারণে রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। এদিকে জরাজীর্ণ রেল সেতু দিয়ে বছরের পর বছর ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। কোথাও সেতুর দুপাশের মাটি সরে গেছে। আবার কিছু সেতুর নাট-বল্টু, স্লিপার, ক্লিপ-হুক কিংবা ফিশপ্লেটও নড়বড়ে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো কোনো সেতু এলাকায় ৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করায় ঝুঁকির যাত্রায় বিভিন্ন সময় সেতু ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনায় যাত্রী হতাহতসহ রেল সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো রাজস্ব খাত থেকে মাঝেমধ্যে সংস্কার করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। প্রয়োজন নতুন করে সেতু নির্মাণ।
জানা যায়, বর্তমানে ৩৪০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চল রেলে ১৩৮৭ কিলোমিটার এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলে ১৬৯৮ কিলোমিটার। কিন্তু এসব রেলপথ ঘিরে ৪ হাজার ৫৮৬টি রেলসেতুর অধিকাংশই জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৯০ শতাংশ রেল সেতুই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। অধিকাংশেরই মেয়াদ শেষ। শত বছর পুরোনো ঝুঁকির এসব সেতু দিয়েই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখার অসম চেষ্টা। ফলে উনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুতিসহ দুর্ঘটনা ঘটছে। রেল সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলের মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুগুলোর বেশিভাগই শুধু ইট-বালি-চুন দিয়ে তৈরি। কোনো ব্রিজে রড-সিমেন্ট ছিল না। এর ফলে প্রকৌশলীদের ফোরকাস্ট অনুযায়ী এসব সেতু ২০-২৫ বছর হলেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। সেতু সংস্কারে সম্পৃক্ত এক প্রকৌশলী জানান, রড সিমেন্টবিহীন এসব সেতুর পিলার দিন দিন নরম হয়ে পড়ে। ফাটল ধরে, দেবে যায়। জীর্ণ সেতুগুলোর পিলার টিকিয়ে রাখতে-রড-সিমেন্টের সমন্বয়ে জ্যাকেট সিস্টেম আস্তর দেয়া হচ্ছে। শত শত সেতু বছরের পর বছর ধরে আস্তর দিয়ে টিকিয়ে রাখার অসম চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ এমনও গুরুত্বপূর্ণ সেতু রয়েছে— পূর্বাঞ্চল রেলে মেজর সেতু ১৫৫টি এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলে ২৫০টি। বহু গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু রয়েছে বহু বছরের পুরোনো-জীর্ণ। এছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলে ৯টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ১৬টি কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতু রয়েছে। একইসঙ্গে পুরো রেলপথে ১ হাজার ২২৫টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং এলাকায় ঝুঁকির সেতুও আছে। রেলে সেতু এলাকায় সাধারণত লেভেল ক্রসিং করা হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তদবির করে লেভেল ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে জরাজীর্ণ সেতু এবং এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিংকেন্দ্রিক এলাকায়। সেতুর উপরে থাকা রেলপথের স্লিপার সবই কাঠের। কাঠের স্লিপারগুলোও নড়বড়ে, ভেঙে থাকে অনেকাংশে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, জীর্ণ পুরোনো সেতু মেরামত করে সচল রাখা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। তা ছাড়া বৃষ্টি বেশি হলে কিংবা পাহাড়ি ঢলে প্রায় পুরোনো ব্রিজের দুপাশ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিভিন্ন সেকশনে ট্রেন বন্ধ রেখে মেরামত করতে হচ্ছে সেতু ও ব্রিজের দুই পাড়। আবার কখনো পুরো লাইন পানির তোড়ে ভেঙে পড়ে, এমনকি অনেক সময় পুরো সেতু ধসে পড়ে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটেও অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এর পরও তেমন কোনো সুফল মিলছে না। একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, জনবলসংকট, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যসহ নানা অব্যবস্থাপনা লেগেই আছে।
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলের একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। গত ১৫ বছরের প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। চলমান রয়েছে আরও প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে রেলের জরাজীর্ণ লাইন ও রেলওয়ে সেতু উন্নয়নে কোনো নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। জীর্ণ সেতুগুলো ভেঙে নতুন সেতু তৈরির কোনো প্রকল্পও গৃহীত হয়নি।
গণপরিবহন বিশ্লেষক ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলে বর্তমানে একমুখী উন্নয়ন চলছে। নতুন নতুন লোকোমোটিভ, কোচ কেনা হচ্ছে। এসব কেনাকাটায় ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এতে যাত্রীসেবার মান বাড়ছে না। এ লোকোমোটিভ ও কোচ যখন দেশে আনা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে যে, এগুলো পরিচালনার জন্য মানসম্মত লাইন নেই। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব লাইন মেরামত না করেই কেনাকাটা করা হচ্ছে। এতে রেলের গতি বাড়ছে না। রেলের গতি কমছে। নতুন রেললাইনের পাশাপাশি পুরোনো রেললাইনগুলো মেরামত করতে হবে। মেরামতের পেছনে কম টাকা খরচ হয় বলে রেল সব সময় বাহির থেকে লোকোমোটিভ ও কোচ কেনায় আগ্রহী। আবার রেললাইন ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নামেমাত্র করা হচ্ছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা কেনাকাটায় মন না দিয়ে বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ সংস্কার করাটাই হবে প্রথম কাজ।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ