নানা জটিলতায় এখনো অনিশ্চিত বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের জোরালো তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ল্যাবটি স্থাপনে জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ল্যাবটি স্থাপনে ৭টি কোম্পানিকে দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। তবে ঠিক কবে নাগাদ ল্যাবটি স্থাপন কাজ শেষ হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
অন্যদিকে, ল্যাব স্থাপনে অনুমোদিত কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কোম্পানিগুলোর কাছে পিসিআর ল্যাব আদৌ আছে কিনা তাও পরিষ্কারভাবে বলছে না কেউ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এদিকে, কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ থেকে ৫০ জন শ্রমিক নিতে সংযুক্ত আরব-আমিরাতকে অনুরোধ করেছে বেবিচক। তবে গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকদের নেয়া হবে কিনা তার জবাব মেলেনি। অথচ বেবিচক আশা করেছিল আজ বুধবার ওই ৫০ শ্রমিককে পাঠাতে পারবে। তোড়জোড় শুরু হওয়ার পরও পিসিআর ল্যাব স্থাপন না হওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকে কথা বলতে গিয়ে আহাজারি করেছেন। অপরদিকে, ল্যাব স্থাপন করতে গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ও বেবিচক চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন। দুই মন্ত্রী বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই ল্যাব স্থাপন করার চেষ্টা চলছে। তবে স্থাপনের পর কবে নাগাদ চালু হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলেননি।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, আটকেপড়া প্রবাসীদের ফিরে যাওয়ার স্বার্থে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আরটি-পিসিআর মেশিন স্থাপন করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে ল্যাব স্থাপনের জন্য জায়গা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন করে ৫০ শ্রমিককে আরব-আমিরাতে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ল্যাবটি স্থাপন করতে স্বাস্থ্য ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, সরকার উদ্যোগ নিলেও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র (দ্রুততম সময়ে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা) বসাতে আরো সময় লাগবে। চলতি মাসে শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পিসিআর মেশিনটি সুদূর আমেরিকা থেকে আনার কথা রয়েছে। আর মেশিনটি আসার পরও অন্তত ১৫ দিন লাগতে পারে বলে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে আরটি-পিসিআর ল্যাব না থাকায় ছুটিতে দেশে এসে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন কয়েক হাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) প্রবাসী।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার চাইলে মাত্র সাত দিনের মধ্যে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসিয়ে দ্রুততম সময়ে আটকেপড়া প্রবাসীদের ফেরত পাঠাতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ল্যাব বসাতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে এসে আটকেপড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসীদের বিষয়টি বিবেচনা করে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। এজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর মেশিন বসানোর জন্য দুটি কমিটি করে দেয়া হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে দুটি কমিটি করা হয়েছিল। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সরকার বেসরকারি সাতটি প্রতিষ্ঠানকে পিসিআর স্থাপনের অনুমতি দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, স্টেমজ হেলথ কেয়ার (বিডি) লিমিটেড ঢাকা, সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, এএমজেড হাসপাতাল লিমিটেড, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গুলশান ক্লিনিক লিমিটেড ও ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক। তার মধ্যে সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার ও স্টেমজ হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে অতীতে করোনার ভুয়া সনদ দেয়াসহ টাকার বিনিময়ে নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ফল দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর ডিএমএফআর মলিকিউলারের প্রস্তাবনায়ও ছিল নানা অসঙ্গতি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচক ও বিমানবন্দরের কয়েক কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদিত কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা আদৌ পিসিআর ল্যাবটি স্থাপন করতে পারবে কিনা সন্দিহান। কারণ পিসিআর ল্যাবটি আমেরিকা থেকে আনতে হয়। এখন তাদের কাছে যন্ত্রটি আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। আর যদি থেকে তাকে তাহলে অন্তত পনেরো দিন লাগবে। ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, আরব-আমিরাতসহ অন্য দেশের প্রবাসীদের বেলায়ও পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পিসিআর ল্যাব স্থাপন করতে। যেসব বাংলাদেশি দেশে এসে আটকা পড়েছেন তাদের ফিরতে হলে অবশ্যই আরটি-পিসিআর টেস্ট করাতে হবে। এরই মধ্যে আরব আমিরাত জানিয়ে দিয়েছে। তারপরও সেই মেশিন বসানো সম্ভব হয়নি। এতে অনেকের ভিসার মেয়াদ চলে গেছে।
গতকাল শাহজালালে সরেজমিনে দেখা গেছে, আটকাপড়া অনেক প্রবাসী জটলা বেঁধে আছেন। বিমানবন্দরের সিকিউরিটি গার্ড বা কর্মকর্তা সামনে পেলেই জিজ্ঞাসা করছেন, স্যার পিসিআর ল্যাব কি ঠিক হয়েছে? আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জন্য কিছু একটা করেন। কিন্তু প্রবাসীদের কোনো উত্তর দিতে পারেননি। সাখাওয়াত হোসেন নামে এক প্রবাসী জানান, সাত মাস আগে দুবাই থেকে দেশে আসেন। ওই দেশে তিনি প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করছেন। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাকে দুবাই যেতেই হবে। ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিসিআর পরীক্ষা করাতে না পারলে আর যেতে পারব না। খোকন নামে আরেক প্রবাসী জানান, সরকার প্রধান নির্দেশ দেয়ার পরও মেশিনটি স্থাপন হয়নি। এখন আমাদের কী হবে বুঝতে পারছি না। ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে যদি ওই দেশে যেতে না পারি তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। গিয়াস নামে আরেক প্রবাসী বলেন, গত মাসে আরব আমিরাত জানিয়েছে বিমানবন্দরে ল্যাব না থাকলে ওই দেশে প্রবেশ করা যাবে না। এতদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও মেশিন স্থাপন না হওয়া দুঃখজনক। বিশে^র প্রায় দেশেই পিসিআর ল্যাব রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে তা নেই।
বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, আরব আমিরাত সরকারের নির্দেশনায় বিপাকে পড়েছেন অন্তত ২০ হাজার প্রবাসী। বিমানবন্দরে পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা না থাকলে দেশটিতে পাঁচ দেশের নাগরিকরা প্রবেশ করতে পারবেন না। তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। পাশাপাশি পিসিআর না করাতে পারলে নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, জাম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকরাও ওই দেশে যেতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, তিন দিন আগে বেবিচকের পক্ষ থেকে ৫০ জন শ্রমিককে প্রবেশের অনুমতি দিতে আরব আমিরাতের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আমরা বলেছিলাম আগামীকাল (আজ) বুধবার তাদের নিয়ে যেতে। এখনো ওই দেশ আমাদের কিছু জানায়নি।
প্রাথমিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষা করা হবে। বিমানবন্দরে ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকে মোবাইল ল্যাব রয়েছে, তাই এই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করবে। পরে আরব আমিরাতের সিদ্ধান্তের পর বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ল্যাব বসানোর সুযোগ পাবে। গত বৃহস্পতিবার অনুমোদিত সাত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন বেবিচক চেয়ারম্যান।
বেবিচকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় তিন মাস ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞার পর গেল ৪ আগস্ট বাংলাদেশসহ ছয় দেশের যাত্রীদের ট্রানজিট সুবিধা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে শর্ত দেয়া হয়, ফ্লাইট ছাড়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে র্যাপিড পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্টপ্রাপ্ত যাত্রীরা আরব আমিরাতে প্রবেশ করতে পারবেন। যদিও সেখানে গিয়ে আরো একবার তাদের করোনা পরীক্ষা করা হবে। আর এই শর্তে অনিশ্চয়তায় পড়েন প্রবাসীরা।
এদিকে, গতকাল সকালে বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বেবিচক চেয়ারম্যানসহ দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এই সময় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বিমানবন্দরে পার্কিংয়ের ছাদ তৈরি করতে ১০ দিন লাগবে। ভেতরে যে জায়গা আছে, সেটা তৈরি আছে। দুই/তিন দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। যারা কাজ করবে বলেছে, যদি এখন তারা বলে যন্ত্র নেই, আমদানি করতে হবে, তাহলে আমি বলব বাড়িতে যাও। তিনি আরো বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত চেয়েছে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার বসাতে। আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করতে সময় বেশি লাগে। তবে র্যাপিড পিসিআর করতে সময় কম লাগে। করোনার পরীক্ষাগার কবে চালু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো এক সপ্তাহ আগে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ইনভলভমেন্ট এটা একটা সমস্যা। তিন দিনের মধ্যে বিমানবন্দরের করোনা পরীক্ষাগার চালু হবে আশা করছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার লাগবে, সেই পরীক্ষাগার বসাতে জায়গা লাগবে। দ্রুত এই কাজ শুরু করার জন্য বিমানবন্দরের ভেতরে একটি জায়গা দেয়া হয়েছে। যাদের অনুমোদন তারা আপাতত ছোট আকারে সেখানে পরীক্ষাগার বসাবে। বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিংয়ের ছাদে স্টিলের কাঠামো করে পরে করোনার আরেকটি পরীক্ষাগার বসানো হবে। মজবুত সেই জায়গা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকবে, পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে। এটা করতে তো একটু সময় লাগবে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ