ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

কেতাবেই আছে, বাস্তবে নেই

প্রকাশনার সময়: ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৩

পথচারীদের ফুটপাতে নিরাপদে হাঁটাচলার অধিকারের কথা শুধু কেতাবেই লেখা আছে, বাস্তবে নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় কত কিলোমিটার ফুটপাত তা লেখা থাকলেও এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। অনেক সড়কের ফুটপাত একেবারে উধাও। এমনকি ফুটপাত নিয়ে এক একটি সংস্থার পরিসংখ্যান এক এক ধরনের। যার হিসাব মেলানো দায় বলে মনে করছেন নগর বিশ্লেষকরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক সড়কের ফুটপাতের ওপর দোকান বসে। আবার আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো স্তূপ করে রাখে ইট-পাথর-বালু। কখনো কখনো গাড়ি দাঁড়ানো থাকে কিংবা চলে মোটরসাইকেল। আবার কোথাও কোথাও ফুটপাত দখল করে দোকানের পণ্যসামগ্রী রাখা হয়েছে। ফুটপাতের ওপর কোথাও গাছ, কোথাও আবার বিদ্যুৎ, মেট্রোরেল বা টেলিফোনের খুঁটি, সুইচ বক্স। কোথাও ফুটপাতজুড়ে বসেছে ফুটওভার ব্রিজের খুঁটি, সিঁড়ি। আছে পুলিশ বক্সও। বিভিন্ন বিপণি বিতানের সামনে ফুটপাতের দখল নিয়েছে যানবাহন। আর হকাররা তো আছেই। আবার মাঝে মধ্যে ফুটপাত উধাও। নগরীতে জীবন যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে চলাফেরা।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ-ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ রহমান বলেন, বাংলাদেশে কর্তাব্যক্তিরা ফুটপাতকে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেন না বলেই সেদিকে নজর দেয়া হয় না।

তিনি বলেন, ‘সবার আগে যদি পথচারী গুরুত্ব পায়, তাহলে সব কিছুর পরিবর্তন হবে। বিভিন্ন নীতিমালায় পথচারীদের জন্য অনেক কিছু করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেই সব নীতিমালার ধারেকাছে আমরা নেই। কোনো প্রজেক্ট নেই, ধারাবাহিক কোনো কাজ নেই।’ মারুফ রহমান বলেন, ‘আমাদের ফুটপাত পথচারীবান্ধব তো নয়ই, বরং পথচারীবিরুদ্ধ পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। পথচারীরা চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, অথচ পাঁচশ’ কোটি টাকা হলেই পথচারীদের চলাচল নিশ্চিত করা যায়। সেটা করা হচ্ছে না।’

নাজমা খাতুন। ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে মধ্যবাড্ডা অভিমুখে। সেখানে ইউ লুপের নিচ পর্যন্ত যেতে ফুটপাত থেকে তাকে ১৮ বার মূল সড়কে নামতে হয়েছে। কারণ স্থানে স্থানে ফুটপাত দখল করে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হয়েছে। চলতি পথের এই বিড়ম্বনা নিয়ে জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এই কর্মজীবী নারী বললেন, ‘এখানে ফুটপাত কিন্তু বেশ প্রশস্ত। অথচ দেখেন, স্থানে স্থানে পুরোটাই দখল করে রাখা হয়েছে। এদের কারণে বারবার মেইন রোডে নামতে হচ্ছে। যে কোনো সময় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।’

নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আদর্শ নগরীতে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ সড়ক থাকতে হয়। সেখানে অলিগলিসহ ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। মেইন রোড আছে ৩ ভাগ। এই ৩ ভাগের ৩০ ভাগ অবৈধ দখলদালদের কব্জায়। যার একটি অংশ হচ্ছে হকাররা। ঢাকার যেসব সড়কে ফুটপাত রয়েছে তার ৭০ শতাংশই বেদখলে। আর বাকি ৩০ শতাংশের ২২ ভাগ খুব নিম্নমানের। ব্যবহারের উপযোগী ফুটপাত মাত্র ৮ শতাংশ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের গবেষণা ‘ঢাকাস বিআরটি ওয়াকেবিলিটি স্ট্রাটেজি’ অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়কের পরিমাণ ২২৮৯.৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ফুটপাতের পরিমাণ মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার। ফুটপাতের ৬৬.২৫ শতাংশ এখন হকারদের দখলে। ফুটপাতে হকাররা দোকানপাট বসিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৯২ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে, উত্তর সিটিতে আছে ২২৩ কিলোমিটার। অভিজাত এলাকার সামান্য অংশ বাদ দিলে পুরো শহরের অধিকাংশ ফুটপাতের অবস্থাই মোটামুটি এক। এর অনেকাংশই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাতগুলো দখলে থাকায় ভোগান্তির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। যানজটের নিগড়ে পিষ্ট মানুষের কাছে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

আবার পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার মোট সড়কের পরিমাণ ২২৮৯.৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ফুটপাতের পরিমাণ মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। যার মধ্যে ৪৪ ভাগ সড়কের পাশে ফুটপাত নেই। ৪৫ শতাংশ সড়কে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা হয়। এসব কারণে মানুষ ফুটপাত ব্যবহার করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। ৩৯ শতাংশ পথচারীই ফুটপাত ব্যবহার করেন না।

বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতির জরিপ অনুযায়ী, নগরীর ৪০০ কিলোমিটার ফুটপাতের ১৩ ভাগ হকারদের দখলে, ১৫ ভাগ দোকান মালিকদের দখলে, পাবলিক টয়লেট ও অন্যান্য যাত্রী ছাউনি ৫ শতাংশ, রাজনৈতিক দলের অফিস ১ শতাংশ, সব মিলিয়ে ৪৮ শতাংশ বিভিন্ন দখলে রয়েছে এবং ৫২ শতাংশ উন্মুক্ত রয়েছে।

মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে ফুটওভার ব্রিজের খুঁটি ও সিঁড়ি করা হয়েছে ফুটপাতের ওপর। তাতে পুরো ফুটপাতই দখল হয়ে গেছে। একটু ফাঁকা জায়গা দিয়ে একজন পথচারী কোনোমতে যেতে পারেন। তবে সে জায়গাটি ছিন্নমূল মানুষের প্রাকৃতিক কাজ সারার জায়গা হয়ে গেছে। সব সময় নোংরা থাকে বলে পথচারীরা সেদিক আর মাড়ান না।

গুলিস্তান পার্কের দক্ষিণ পাশের সড়কে ফুটপাত একেবারে উধাও। এখানে সড়কের একপাশ ভাঙাচোরা, সেখানে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার করা হয়েছে। সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের কাছে নতুন ফুটপাত করেছে ডিএসসিসি। প্রশস্ত এ ফুটপাতের একটি অংশে আবার যাত্রী ছাউনি করা হয়েছে। ছাউনির একপাশে একটি টিকিট কাউন্টার ফুটপাতের পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকা নিয়ে আধুনিক ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। নগর পরিকল্পনায় রাস্তার পাশে এসব দোকান বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে, সুতরাং এ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।’

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘আমরা ফুটপাত দখলমুক্ত করে চলে আসার পর অনেক জায়গায়ই তা আবার দখল হয়ে যায়। তবে ফুটপাত সার্বক্ষণিক দখলমুক্ত রাখতে ডিএনসিসি কঠোর হচ্ছে। জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। আসলে আমাদের দেশের বাস্তবতা একটু জটিল। অল্প জায়গার মধ্যে আমরা অনেক লোক বাস করি, তাদের জীবিকারও একটা বিষয় আছে। তাই চাইলেই একেবারে সব কিছু করা সম্ভব নয়। আমরা তাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছি।’

নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, এ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলা চললেও মূলত প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এর নেপথ্যে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ রয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।

এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে তারা কোনো না কোনোভাবে এসবের সঙ্গে জড়িত। অবৈধ দখলদারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারছে না বলেই ফুটপাতের একটি বড় অংশ হকারদের দখলে চলে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে। তবে হকারদের ফুটপাত দখলের অবৈধ কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে তারা নীরব থাকা হচ্ছে। সরকারের যেসব সংস্থা বা কার্যালয় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনলেই এসব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’

অন্যদিকে হকার নেতারা বলছেন, তাদের ঘাড়ে ভর করে পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা ফুটপাত দখল বাণিজ্য চালাচ্ছেন। তারা হকারদের কাছ থেকে দৈনিক মোটা অংকের চাঁদা তুলছেন। যার একটি অংশ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের হাতে পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। হকাররা যতটা জায়গা দখল করে দোকান বসাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী দোকান মালিকদের দখলে রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, ‘পথচারীদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য পুলিশ সব সময় তৎপর থাকে। শুধু সিটি করপোরেশন যেখানে অনুমোদন দেয়, সেখানেই পুলিশ দোকানপাট বসাতে দেয়। তবে পুলিশকে মানবিক এবং আইনগত দিকও বিবেচনা করতে হয়।’

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘যানজটের কারণে শহর চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য প্রশাসনের ব্যর্থতা দায়ী। তারা সঠিকভাবে কাজ করে না। উল্টো এ ফুটপাত অবৈধভাবে ইজারা ও টোল আদায় করে অনেকে বাণিজ্য শুরু করেছে।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার আইনগতভাবে সেটা নিশ্চিত করবে। কিন্তু, মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে তো ব্যবসার সুযোগ দিতে পারে না।’

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ