মাদারীপুর সদর উপজেলার হাসানকান্দি গ্রামের একটি মোড়ের নাম ‘ইতালি মোড়’। ওই গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ ইতালিপ্রবাসী। এ কারণেই এমন নামকরণের কারণ। শুধু হাসানকান্দি নয় মাদারীপুরের আরও কয়েকটি গ্রামে আছে ইতালিপ্রবাসীদের ছড়াছড়ি।
তবে তাদের বেশিভাগই গেছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ পথে। অবৈধভাবে গেলেও তাদের ওপর ভর করে বদলে গেছে অধিকাংশের পারিবারিক অবস্থা। ইতালিপ্রবাসী ও তাদের পরিবারের এ ভাগ্যবদল দেশটিতে যেতে আগ্রহী করেছে মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর যুবকসহ বিভিন্ন বয়সিদের। এ স্বপ্নকেই পুঁজি করে জেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর মানব পাচারকারী চক্র। লিবিয়া থেকে শুরু করে জেলার গ্রাম পর্যন্ত এ চক্রের বিস্তার। জনপ্রতিনিধিরাও আছেন এ চক্রে।
অন্যদিকে, তুরস্কে চাকরির কথা বলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ জনকে কিরগিজস্তানে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন ও পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ করেছেন তাদের স্বজনরা। অভিযোগ উঠেছে, চক্রটির প্রতারণার শিকার হয়েছেন বিভিন্ন জেলার ৫৩ জন।
সবাইকেই কিরগিজস্তানের কতাগিরি অঞ্চলের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ তাদের বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি কয়েক লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই ৯ জনকে পাচারের অভিযোগে সদর মডেল থানায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮ জনের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করা হয়। এরকম অহরহ ঘটনা রয়েছে মানবপাচারের। প্রতিমাসেই এ ধরনের খবর পাওয়া যায়।বিদেশ পাড়ি দিলে উচ্চ বেতনে চাকরি, উন্নত জীবন আর নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয় নিরীহ মানুষদের। বিদেশে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। সেই নির্যাতনের অডিও-ভিডিও দেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে অর্থ আদায় করা হয়। শুধু এই নয়; মানব পাচারকারীদের সহায়তায় বিদেশে বাংলাদেশিরা অপহরণেরও শিকার হচ্ছে। এছাড়া মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে শত শত নারী-পুরুষ দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
এমনকি হারাচ্ছেন জীবনও। এদিকে, বিয়ে করে ভারতে পাচারের ঘটনা পুরোনো একটি বিষয়। এখনো সেটি অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশের পাচারকারী চক্র বাংলাদেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী ও শিশুদের সরলতা ও অসচেতনতাকে পুঁজি করে তাদের বিক্রি করে দিচ্ছে যৌনপল্লিতে। ফলে ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে শিশু, কিশোরী ও নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও কুষ্টিয়ার লোকজন এ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে মানব পাচারের হটস্পট হিসেবে উঠে এসেছে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর জেলার নাম।
দেশে মানব পাচার প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে আগামী দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সিকিউরিটি ডিভিশনের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং (আপডেটেড ২০২৩-২৫) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ এবং যশোর জেলা মানব পাচারের হটস্পট হয়ে উঠেছে। এ তিন জেলার মতো অতিরিক্ত মানব পাচারের মামলা যেসব জেলায় রয়েছে, সেখানে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে। এসব বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে সঠিক অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। সেখানে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস্থায় এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের হয়রানি বা সেবা প্রাপ্তিতে বাধা তৈরি করা যাবে না।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে যশোর সীমান্তে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর কাছে যশোরের শার্শা উপজেলার একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের তথ্য রয়েছে। উপজেলার বাহাদুরপুর, পুটখালী ও বেনাপোল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম একেবারে সীমান্তঘেঁষা। এখান দিয়ে স্বর্ণ, অস্ত্র, গরু, বিস্ফোরক ও মানব পাচার করা হয়। যশোরের পাশাপাশি কক্সবাজারের টেকনাফকেন্দ্রিক দুটি চক্রের তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রয়েছে। সেখানে মূলত জল সীমান্ত ব্যবহার করে পাচারের ঘটনা ঘটে।
ময়মনসিংহ থেকে সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ে মানব পাচারের কয়েকটি চক্রের তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রয়েছে। জেলার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া, পোড়াকান্দুলিয়া ও ঘোষগাঁও দিয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ের বাঘমারায় নিয়ে ভুক্তভোগীদের নির্যাতন করে অর্থ আদায় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অর্থ আদায়ের পর ভুক্তভোগীদের মুক্তি দেয়া হয় না।
বরং বিক্রি করে দেয়া হয় অন্য চক্রের কাছে। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মানব পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি জানিয়েছেন, দেশের সীমান্তবর্তী চার জেলার ১০টি পয়েন্ট মানব পাচারের রুট হিসেবে চিহ্নিত হলেও কোনোভাবে পাচার থামছে না।
যশোরের বেনাপোল, পুটখালী, সাদীপুর, শিকারপুর, কৈজারি, বৈকারি, ভোমরা, কলারোয়া, কাকডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের কয়েকটি পথকে মানব পাচারের রুট হিসেবে তুলে ধরে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। ফলে পাচার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মানবপাচার ঠেকাতে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পাচারের শিকার হওয়া নারী-পুরুষদের বিদেশ থেকে ফেরত আনতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও-ও এ নিয়ে কাজ করে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ