ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

বাম দলে নয়া মোড়

প্রকাশনার সময়: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:৩৩
ফাইল ছবি

দেশের বামপন্থি দলগুলোতে সাংগঠনিক দুর্বলতা চরমে। ক্রমশই রাজনীতির মাঠে গতিহারা হয়ে পড়ছে। গ্রুপিং-কোন্দল আর মতভেদের শেষ নেই। ফলে বারবার আন্দোলন কথা বললেও সরকারকে বড় কোনো ধাক্কা দিতে পারছে না বাম দলগুলো। আবার বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিলেও, সেখানে রয়েছে মতভেদ। দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত পার্থক্যও কম নয়। টানাপড়েন চলছে এখনো। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করার দাবিতে রাজপথে এবার ঐক্যবদ্ধভাবে তারা জোরালো ভূমিকা রাখবে প্রত্যাশা বামপন্থি দল ও জোটের নেতাদের। একই সঙ্গে জোট থেকে সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চায় তারা। এমনটি জানিয়েছেন বামদলীয় নেতা ও ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ সংশ্লিষ্টরা।

বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলছেন, আদর্শগত রাজনীতি করতে গিয়ে বাম দলগুলোর মধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ কারণে বারবার দলগুলো ভাঙনের কবলে পড়ছে। তারপরও ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন দলীয় নেতাকর্মীরা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো লোকবল না থাকলেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো ইস্যুতে প্রথমে রাজপথে নামে বাম দলগুলোই।

তারা আরো বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে কয়টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তার বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করছে। স্বাধীনভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কোনো কাজ করেনি তারা। তাই এবার কোনো সার্চ কমিটি দিয়ে নয় বরং আইন করে স্বাধীন ইসি নিয়োগ দিতে হবে। আন্দোলনরত সবার মতামতের ভিত্তিতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। যদি এবারো আগের মতো কমিশন গঠিত হয় তাহলে বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দেবে বাম দল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, আমরা আসলে একটা সমাজতান্ত্রিক বৃহত্তর জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এখনো সেটা চেষ্টার পর্যায়ে আছে। আলাপ-আলোচনা চলছে। কিছু বিষয় ইতোমধ্যে ঠিক করেছি। বাম জোট ছোট-বড় আন্দোলন করছে। দলগুলোর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত পার্থক্য ছিল তবে এখন অনেকটা কমে এসেছে। সবাই একমত যে, আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও নিরপেক্ষ সরকার বা ইসি ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই।

সাধারণভাবে জনগণের দাবি নিয়েই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে সরব হয় বাম দলগুলো। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে বাম দলগুলোর সোচ্চার প্রতিবাদ দেখেছে সাধারণ মানুষ। পাটকল ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের দাবি আদায়েও মাঠে সক্রিয় দলগুলো। তবে দেশে অনেক বাম দল থাকলেও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় কেবল কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিতে রাজপথে দেখা মেলে বামদের। দেশের বাম দলগুলোর একটি অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে সংসদে আছে। আর অধিকাংশ বাম দলই নিষ্ক্রিয়। তাদের দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। কয়েক বছর ধরে বাম জোট রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠছে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় বাম দলগুলো। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে সক্রিয় বাম জোট। তাদের জোটে ভেড়াতে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ।

এদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অন্তত তিনটি বাম দল। দলগুলো হলো- বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। জোটের কর্মসূচিতেও যাচ্ছেন না তারা। জোটে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে দলগুলোর নেতারা। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাহাস চলছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান কর্মকা-ে তারা অসন্তুষ্ট।

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, আমরা ১৪ দলের কোনো কর্মসূচিতে যাই না। শুরুতে ১৪ দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। জোটটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছে। এখন আর সে অবস্থা নেই। আওয়ামী লীগ যদি আলাপ না করতে চায়, তাহলে আমরা তো তাদের বাধ্য করতে পারব না।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বি-দলীয় বৃত্তের রাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই আত্মপ্রকাশ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই জোটে থাকা ৮টি দলের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লিগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। গত বছর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটা অংশ বেরিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্ক্সবাদী) নামে নতুন দল করে। এই দলটিও বাম জোটে যুক্ত হয়। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেবল কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর এই জোটের শরিক কোনো দল থেকে কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর থেকেই ভোট ও সমর্থন দুইটাই কমেছে প্রতিদিন।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, বাম দলগুলোর কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন দাবিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে সরকারের ব্যর্থতা ও জুলুম-অন্যায়ের কথা জনগণের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও ইসি পুনর্গঠনের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার প্রতিবাদে মাঠে দেখা যাবে বামপন্থিদের।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জনজীবনের প্রতিটি ইস্যুতে বামপন্থিরা সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে রাজপথে সোচ্চার ও সরব রয়েছে। তবে আমাদের সামর্থ্যরে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা টাকার রাজনীতি করি না। ফলে কর্মীরা নিজেদের সীমিত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে রাজপথে সক্রিয় থাকেন। আছে সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতাও। এরপরও দুর্যোগ, নিত্যদিনের সংকট আর মহামারিতে মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সবার আগে এগিয়ে আসেন বামপন্থিরা।

সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন বলেন, করোনা মহামারির জন্য আমাদের রাজনৈতিক কর্মকা- সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম জারি রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার পতনের দাবিতে বাম জোটের উদ্যোগে রাজপথে লড়াই আরো জোরদার হবে। এ সরকার যত দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বে, জাতির জন্য সেটি তত কল্যাণকর হবে।

তিনি বলেন, এ সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবি আদায়ে কমরেডরা লড়াইয়ের মাঠে রয়েছেন। আমরা নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকা- করি না। জনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। তবে পরিবেশ ভালো থাকলে অবশ্যই নির্বাচন করবে বাম জোট। জোট থেকে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা করবে।

নির্বাচনের আগে জোটের পরিধি আরো বাড়বে জানিয়ে ক্বাফী রতন আরো বলেন, আট দল নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাম গণতান্ত্রিক জোট যাত্রা শুরু করেছিল। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির যোগ দেয়ায় জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। অন্য বামপন্থি জোটগুলোর সঙ্গে আরো নৈকট্য তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আগামীতে জোটে আরো কয়েকটি দল ও বাম জোট যোগ দিতে পারে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ