ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চোরাইপণ্য আবার রফতানি

প্রকাশনার সময়: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৪৯
ফাইল ছবি

রফতানির জন্য তৈরি পোশাক বন্দরে যাওয়ার পথে কৌশলে সরিয়ে ফেলে তা আবার বিদেশেই পাঠানো হচ্ছে। আর চোরাই সব পণ্য রফতানিতে কাজ করছে তিন স্তরের একটি শক্তিশালী চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি একাধিক সদস্য। চোরাই মালামাল লুকিয়ে রাখার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে গড়ে উঠেছে অন্তত ৭টি গোডাউন। সেখান থেকেই পরে এসব মালামাল নতুন প্যাকেটে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি তৈরি পোশাক লুটের দুটি ঘটনায় গ্রেফতার ১১ জনের কাছ থেকে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ইমরান নামে একজনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে চুরি চক্রের আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা নয়া শতাব্দীকে বলেন, গার্মেন্টের এসব চোরাইপণ্য কেনাবেচার শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে কাভার্ডভ্যানের চালক-হেলপার, বিভিন্ন বায়িং হাউজ ও বিদেশি বায়াররাও জড়িত। মালামাল চুরির পর ঢাকা চট্টগ্রাম রুটের কয়েকটি গোডাউনে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর তা হাতবদল হয়ে আবারো বিদেশে চলে যায়। এই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানা গেছে, আশুলিয়ার জয়ন্তী নিট ওয়্যার লিমিটেডের পক্ষে বুলবুল আহম্মেদ গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় বলা হয়, ১১ সেপ্টেম্বর রাতে শিল্পাঞ্চল এলাকার বেলায়েত ট্রান্সপোর্টের চালক এমরান ও তার সহযোগী মহিউদ্দিন, মোবারক, রিপন সাইদসহ অনেকে মিলে শিপমেন্টের জন্য ২৮ হাজার ৮২০ তৈরি পোশাক চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার পথে ১১ হাজার পিস মাল চুরি করে। এতে বায়াররা তাদের কাছে ২৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তের এক পর্যায়ে এমরানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এমরান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি মহিউদ্দিনের নির্দেশে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার একটি গোডাউনে মালামাল নামিয়েছেন বলে দাবি করেন। ওই ঘটনার পর মহিউদ্দিনসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেখানো মতে উদ্ধার করা হয় চোরাইকৃত পোশাক। এ ঘটনায় পুলিশ তাদের কাছ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের একাধিক গোডাউনের সন্ধান পায়। বিশেষ করে বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনের পাশে এ ধরনের ৭টি গোডাউন গড়ে উঠেছে। শুধু কুমিল্লা এলাকায়ই পাওয়া যায় ৩টি গোডাউন। গাজীপুরে রয়েছে একটি ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ৩ গোডাউন রয়েছে। এসব গোডাউনে কাভার্ডভ্যান ঢোকানোর পর মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যেই মালামাল সরিয়ে ফেলা হয়। আগে থেকেই সেখানে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা উপস্থিত থাকে। গত ১২ তারিখের ঘটনার পর ১৫ তারিখে আবারো নেটওয়ার্ক ক্লোথিং লিমিটেড নামক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের ১৭ হাজার ১৫২ পিস তৈরি পোশাক বিদেশে রফতানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে ৫ হাজার পিস পোশাক চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১৭ তারিখ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় আরো একটি মামলা হয়। এই মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাজ্জাক, ইউসুফ, মাইনুল, আলামিন, দুলাল হোসেন ও খায়রুলকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪ হাজার ৭০৫ পিস গার্মেন্টস তৈরি পোশাকসহ দুটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়। এই দুই ঘটনায় মূল হোতা হিসেবে সাঈদের ওরফে সিলেটি সাঈদের নাম চলে আসে। এরপর সাঈদকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার সাঈদের নামে অন্তত ২৪ মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ মামলা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর থানায়। এছাড়া ডিবিতেও রয়েছে তিনটি মামলা। গার্মেন্টের পণ্য চুরি করেই সাঈদ বাড়ি-গাড়িসহ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এমনকি স্ত্রী-সন্তানদের লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে সাঈদসহ এই চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম জেনেছি, তদন্তের স্বার্থে সেগুলো বলছি না। দেশের ছোট ছোট কিছু বায়িং হাউজে যাচ্ছে সেসব চোরাই গার্মেন্ট পণ্য। আর ওই সব ছোট বায়িং হাউজ বিদেশি ‘ছোট ক্রেতা’দের কাছে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন মার্কেটেও যাচ্ছে সেসব চোরাই গার্মেন্ট পণ্য।

গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্ট থেকে কাভার্ডভ্যানে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। সম্প্রতি এই দুুটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনুমানিক ৫০ হাজার পিস গার্মেন্টে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। বিদেশে পৌঁছানোর পর ক্রয়াদেশ দেয়া মালের পরিমাণের সঙ্গে দেখা যায় বিস্তার ফারাক। এরপর ওই দুই বায়ারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতিকে নির্দেশনা অনুযায়ী কম পণ্য দেয়ার অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে কয়েকটি ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়। এরপর অভিযুক্ত ওই দুই গার্মেন্টের মালিককে ডেকে পাঠানো হয়। তারা বিজিএমইএকে চুক্তি অনুযায়ী সঠিক মাল সরবরাহের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। ইনভয়েস ও চালানের কপিতে উঠে আসে সঠিক পণ্য দেয়ার তথ্য। পরিবহনে যুক্ত কাভার্ডভ্যানের লোকজনও মাল বুঝে নিয়েছে বলে চালানের কপিতে সই করার তথ্যপ্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষও মালামাল বুঝে পেয়েছে বলে তথ্য উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েন বিজিএমইএ’র কর্তাব্যক্তিরা। এমন পরিস্থিতিতে তারা গোয়েন্দা পুলিশের শরণাপন্ন হন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। এরপর তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা যায়, কয়েকটি সিএনজি গ্যাস স্টেশনসংলগ্ন অনেক গোডাউন রয়েছে। ওইসব গোডাউনে আগে থেকেই কার্টন ও পলিথিনের প্যাকেট রেডি করে রাখা হয়। আগে থেকেই জানিয়ে রাখা হয় প্রশিক্ষিত লেবারদের।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা জানান, চোরাই মালামালের বিক্রির টাকা কয়েক ধাপে ভাগ হয়। তবে মাল যে পরিমাণই হোক, প্রতিটি কাজের জন্য চালক ১৫ ও হেলপারের ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা থাকে। মালামাল লুটের পর লেবারদের খরচ মিটিয়ে তা গোডাউন জাত করা হয়। এরপর স্যাম্পল নিয়ে বিভিন্ন বায়িং হাউজের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপেক্ষাকৃত কম দামে তা বিক্রি করে দেয়া হয়। এ দুটি ঘটনায় সাঈদকে গ্রেফতার দেখানো হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ