দেশে যে পরিমাণে দরিদ্র রয়েছে— সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে সুবিধাভোগীর সংখ্যা তার দ্বিগুণ। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ বর্তমানে এ সুবিধা ভোগ করছেন। ফলে এ কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধির আশ্চর্য এক প্রবণতা উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে তৃণমূল পর্যায়ে সুবিধাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের পাশাপাশি দুর্নীতির উদাহরণও পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ঘটছে তহবিলের অপব্যবহার। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে দেয়া ভাতাগুলো আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষদের জন্য বরাদ্দ। তবে নীতিনির্ধারকরা সন্দেহ করছেন, প্রকৃত বঞ্চিতরা প্রয়োজনীয় ও প্রাপ্য সুবিধা পাচ্ছেন না। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের তৈরি করা ‘সামাজিক সুরক্ষা সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান’-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘মোট জনসংখ্যার শতাংশ হিসেবে সুবিধাভোগী আওতাভুক্তির পরিমাণ ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশ। এ সুবিধাভোগী-আওতা বিদ্যমান দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি। এ তথ্য থেকে মনে হতে পারে, সব দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রয়েছে। তবে এতে ভুলবশত অনেককে বাদ দেয়া বা ভুলবশত অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনাও রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নেয়া হলে দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্তি কম হয়ে যায়।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের ১৬ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ বা প্রায় তিন কোটি ১৭ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও শহর ও গ্রামের মধ্যে বড় পার্থক্যের কথা জানা গেছে। শহরের দরিদ্রদের মাত্র ৫০ শতাংশ এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত আছেন। অন্যদিকে গ্রামের ক্ষেত্রে এ হার ১৫০ শতাংশ। কমিশন শহুরে দরিদ্রদের কথা ভেবে সামাজিক কর্মসূচির সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দেয়ার সুপারিশ করেছে।
জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অনেক প্রকৃত প্রাপক তাদের প্রাপ্য সুবিধা পান না। অন্যদিকে কিছু অনুপযুক্ত ব্যক্তি সরকারি ভাতা পান যার প্রভাব পড়তে পারে সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচির ওপর। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, সঠিকভাবে সুবিধাভোগী নির্বাচন এবং তালিকা হালনাগাদ করার জন্য বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারি চলাকালীন নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য ৫০ লাখ দরিদ্র ব্যক্তির তালিকা তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের ৩০ শতাংশ প্রতারক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর টার্গেটিং করা সহজ নয়। তিনি বলেন, অনেক দরিদ্র ব্যক্তি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা থেকে বাদ পড়েছেন, বিশেষ করে শহুরে দরিদ্ররা। তাদের চাহিদা পূরণের জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্মসূচির আহ্বান জানান তিনি।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং দেশের জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। কমিশন এ বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সুবিধাভোগী বাছাইয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তারা প্রায়ই সুবিধাভোগী তালিকা তৈরি করার সময় সম্ভাব্য ভোটারদের রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক সম্পর্কের দিক বিবেচনা করেন। এ কারণে প্রায়শই প্রকৃত দরিদ্ররা বাদ পড়ে যান। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতি প্রায়ই সামাজিক সুরক্ষা উদ্যোগের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের অপব্যবহারের কারণ হয়।
সকল দরিদ্র যে ভাতা পাচ্ছেন না— তার উদাহরণও তুলে ধরেছে পরিকল্পনা কমিশন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিধবা ও দুস্থ মহিলাদের জন্য ভাতা রয়েছে। প্রায় ২৬ লাখ জনগোষ্ঠী এর আওতায় ভাতা পাচ্ছেন। তবে এখনো এক লাখ ৩০ হাজার দুস্থ মহিলা এ কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন।
তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে সুপারিশ করেছে কমিশন। এতিম ও অন্যান্য দুস্থ শিশুদের জন্য কর্মসূচির সংখ্যা অপর্যাপ্ত বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কমিশন।
৬০ বছর বা তার বেশি বয়সি সবাইকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। বর্তমানে বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর ও নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বছর। এছাড়া ৯০ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য বিশেষ সুবিধা চালু করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২৯ লাখ প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। দেশের সব প্রতিবন্ধীকে এ ভাতার আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন।
অর্থ বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মাহবুব আহমেদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের অর্ধেক দরিদ্র, বাকি অর্ধেক সচ্ছল। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে উপকারভোগীর তালিকা করার কারণে যারা তাদের ভোট দেন, তাদেরসহ আত্মীয়স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেসব দরিদ্র মানুষ নেতাদের সঙ্গে বেশি যুক্ত নন, তারা কোনো সুবিধা পান না।
মাহবুব আহমেদ সরকারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সুবিধাভোগী তালিকা যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ দেন। তবে ইউএনওরা যেহেতু স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন, তাই তারাও তালিকা যাচাইয়ে আগ্রহী হন না বলে মনে করেন তিনি।
উপকারভোগীদের তালিকা প্রতিবছর যাচাই-বাছাই করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে তিনি অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ প্রকৃত তালিকা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। না হলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার সামাজিক নিরাপত্তায় বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, তা সফল হবে না বলে মনে করেন মাহবুব আহমেদ।
বিনায়ক সেন বলেন, উপকারভোগী বাছাইয়ে এ মুহূর্তে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার বা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।ন্যাশনাল আইডেন্টিফিকেশন (এনআইডি) কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে ভারতের আধার কার্ড বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কার্ডে ব্যক্তির নাম ছাড়াও তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ আরও অনেক তথ্য থাকে। ভারত দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকদের চিহ্নিত করতে নিয়মিত দারিদ্র্য শুমারি পরিচালনা করে। আধার কার্ডেও ওই তথ্য থাকে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে কিনা। আমাদের দেশেও এনআইডির সঙ্গে আরও কিছু তথ্য যুক্ত করা গেলে হয়তো নিরাপত্তা কর্মসূচির যোগ্য সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হতো।
সামাজিক সুরক্ষায় প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিত করতে এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) প্রবর্তন করা জরুরি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই করতে হবে এবং সচ্ছল ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে দুস্থদের তালিকাভুক্ত করতে হবে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর কার্যক্ষমতা মূল্যায়নের কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে কর্মসূচিগুলোর ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৮তম বৈঠকে সুবিধাভোগীদের জন্য এমআইএস প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া উপকারভোগীদের মধ্যে যারা দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণ করেছেন, তাদের বাদ দিয়ে নতুন উপকারভোগী প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় মোট এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, পেনশনভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, বেদে, হিজড়াসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে নগদ ভাতা দিতে বরাদ্দ রয়েছে ৪৩ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা।
এর মধ্যে আট লাখ নন-ক্যাডার সরকারি কর্মচারী পেনশনভোগীদের জন্য বরাদ্দ ২৭ হাজার ৪১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, মাত্র ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ উপকারভোগী এ খাতে মোট বরাদ্দের ৬৩ দশমিক ১৮ শতাংশ পাচ্ছেন।
এছাড়া দুই লাখ ১৯ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা হিসেবে পাঁচ হাজার ১৭৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অর্থাৎ নগদ বিতরণ খাতের ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ উপকারভোগী এ খাতে বরাদ্দের ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ অর্থ পাচ্ছেন।
বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, মা ও শিশু সুবিধা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী, হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়ের জন্য সহায়তাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য উপকারভোগী বাছাইয়ে সম্পৃক্ত থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও পৌরসভার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। এ কর্মসূচির আওতায় মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক কোটি ২৪ লাখ ৪৫ হাজার জন। সরকার দরিদ্রদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে চাল ও গম সরবরাহ করে।
চলতি অর্থবছরে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচির আওতায় ১৬ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রায় তিন কোটি ৬৮ লাখ মানুষ এ কর্মসূচির সুবিধাভোগী। তাদের মধ্যে ভালনারেবল উইম্যান বেনিফিট প্রোগ্রাম, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং, জিআর, এবং ফুড অ্যাসিসট্যান্স ইন চিটাগং-এইচটিএ-তে খাদ্য সহায়তার উপকারভোগীর সংখ্যা দুই কোটি ৩১ লাখ।
এসব উপকারভোগীদের তালিকাভুক্তি করা হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। নগদ ভাতা এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের অবশিষ্ট অংশ শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করা হয়, যার উপকারভোগীরা প্রকৃত অর্থে দরিদ্র নাও হতে পারে। সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্প মালিকদের জন্য ঋণের সুদে ভর্তুকি দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ভর্তুকি তহবিল বরাদ্দ করে। চলতি অর্থবছরে তিন হাজার ব্যবসায়ীর ঋণে সুদ ভর্তুকি বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।
একইভাবে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে দুই কোটি ১৩ লাখ কৃষককে ঋণ ভর্তুকি দেয়ার জন্য ২১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তরা প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র কিনা, তা কখনো যাচাই করার উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ফলে একবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর প্রতিবছরই সুবিধাগুলো ভোগ করছেন তারা।নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ