ঢাকা, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬

‘দুষ্ট চক্রে’ বিস্তার হচ্ছে ষড়যন্ত্রের জাল

প্রকাশনার সময়: ২০ মার্চ ২০২৪, ০৮:১৩

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (ডিপিডিসির) ঘাপটি মেরে থাকা দুষ্ট চক্রটি ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সংস্থাটিতে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যোগদানের পরই চক্রটি পরিকল্পিতভাবে নিজেদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে। আর এতে টার্গেট করছে সংস্থার সৎ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তিমূলক স্থানে বদলি করিয়ে এমডিকে নিজেদের করায়ত্বে নিয়ে ডিপিডিসিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা। এর প্রাথমিক কার্যক্রম হিসেবে চক্রটি কতিপয় সংবাদকর্মীকে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করে কিছু একনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে। দুষ্ট এ চক্রটি সংবাদকর্মীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নিজেদের দুর্নীতি আড়ালের পাশাপাশি সংস্থার এমডি’র বিশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টায়ও মত্ত। এসবের নেপথ্য নেতৃত্বে ডিপিডিসির ‘র’ আদ্যাক্ষরের প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের (পিডি) দায়িত্বে থাকা একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, ডিপিডিসি’র বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমানের বিশ্বস্ত এবং একনিষ্ঠ উদ্যমী কর্মকর্তাদের বিতর্কিত করার মিশনে প্রথমেই সংস্থাটির নারায়ণগঞ্জ জোনের কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে টার্গেট করেছেন। এরপর তাদের তালিকায় রয়েছে ডিপিডিসি’র প্রধান কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার নাম। এভাবে বর্তমান এমডি’র বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের বিতর্কিত করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাকে দুর্বল করে চক্রটির সদস্যরা তার সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চক্রটি কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কল্পকাহিনি দিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন করিয়ে সংবাদকর্মীদেরও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। পাশাপাশি সুনাম ক্ষুণ্ন করছে খোদ ডিপিডিসি’র। চক্রটি সংবাদকর্মীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নিজেদের দুর্নীতি আড়ালের চেষ্টা করছে। এদের চক্রান্ত থেকে বাদ যাননি সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান। কারণ সাবেক এ এমডি চাকরির শেষ বছরে চক্রটির অনিয়ম দুর্নীতির বিষয় জানতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। বিভিন্ন স্থানে বদলি করে ভেঙে দেন চক্রের সিন্ডিকেট। যার ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে সদ্য সাবেক এমডি বিকাশ দেওয়ানের বিরুদ্ধে কল্পকাহিনি সাজিয়ে সংবাদকর্মীদের সরবরাহ করছে ‘র’ আদ্যাক্ষরের ওই পিডি এবং তার চক্রের সদস্যরা। উদ্দেশ্য দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ‘লুটপাটের সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলা।

সম্প্রতি ডিপিডিসি’র ফতুল্লা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান সরকারসহ একাধিক প্রকৌশলীকে জড়িয়ে নানা নেতিবাচক কল্পকাহিনি সাজিয়ে সংবাদকর্মীদের সরবরাহ করে সংস্থাটির একটি প্রকল্পের পিডি’র দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ‘র’ (আদ্যাক্ষর) নামের ব্যক্তি। তার দুর্নীতি যাতে প্রকাশ না হয় এবং প্রতিপক্ষকে কৌশলে ঘায়েলের লক্ষ্যে তিনি এক শ্রেণির সংবাদকর্মীকে নিয়মিত মাসোহারাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

ফতুল্লা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডিপিডিসিতে আমার ঊর্ধ্বতন প্রায় সব কর্মকর্তার সঙ্গেই আমার সু-সম্পর্ক রয়েছে। ফলে কারও পক্ষে-বিপক্ষে থেকে আমি নিজের ক্ষতি কেন করব? তাছাড়া অভিযোগে যেভাবে আমাকে ক্ষমতাধর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সঙ্গে আমি যে পদে কর্মরত আছি তাতে আদৌ কি সেটা সম্ভব? আমার পদের কারও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কাউকে প্রভাবিত করা বা বিশাল অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করাও কি সম্ভব?

ডিপিডিসি’র অনেক কর্মকর্তার মধ্যে কেনো আপনাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল এমন জিজ্ঞাসায় প্রকৌশলী আহসান সরকার বলেন, ডিপিডিসিতে লুটপাটকারী চক্রের অনিয়ম-দুর্নীতির মোক্ষম স্থান হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জোন। কারণ এ এলাকায় অনেক কলকারখানা এবং হাইরাইজ ভবন রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জোনের বিভিন্ন ডিভিশনে চক্রটির পছন্দের কর্মকর্তা থাকলে তারা নির্বিঘ্নে লুটপাট করতে পারবে এমনটাই আশাবাদ তাদের। আর আমরা এসব ডিভিশনের দায়িত্বে থাকলে তাদের দুর্নীতির কার্যক্রম সহজ হবে না বলেই আমাদের এসব ডিভিশন থেকে বদলি করানোর জন্য নানা রকম কল্পকাহিনি ও মিথ্যাচার দিয়ে চক্রান্ত করছে চক্রটি। পাশাপাশি তারা সংস্থার এমডি’র কাছেও নিজেকে সাধু ব্যক্তি হিসেবে জাহির করতে পারবে এমন আশায় তারা একের পর এক ঘৃণ্য চক্রান্ত করছে। আমার বিশ্বাস শিগগিরই ডিপিডিসি’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিবেন।

এসব ব্যাপারে ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা বলেন, কোনো ধরনের দুষ্টচক্রের ডিপিডিসিতে ঠাই হবে না। যত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই তারা চক্রান্ত করুক না কেন তারা সফল হবে না। তাদের মুখোশ উন্মোচন হবেই। আর এসব অপরাধীরা চিহ্নিত হলেই এদেরকে চরম শাস্তির আওতায় নেয়া হবে। তিনি বলেন, মুখোশধারীরা কখনোই সফল হয় না। বর্তমান এমডি’র নেতৃত্বে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে ডিপিডিসিকে একটি পরিচ্ছন্ন স্মার্ট সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে।

অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সাবেক এমডি বিকাশ দেওয়ানের চাকরির মেয়াদ শেষের দিকে তার বিরুদ্ধে ডিপিডিসিরই একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর নাম ব্যবহার করে অভিযোগ দিয়েছিলেন ‘র’ আদ্যাক্ষরের ওই পিডি। এরপর তিনি ওই অভিযোগের কপি একজন সংবাদকর্মীকে দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তা প্রকাশের অনুরোধ করেন। বিষয়টি এখন অনেকের কাছেই ওপেন সিক্রেট। ফের তিনি তার চক্রের সদস্য হিসেবে থাকা অন্যান্য প্রকৌশলীদের নিয়ে মাঠে নেমেছেন। চেষ্টা করছেন ডিপিডিসিতে নিজের অপরাধের সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার। তিনি চক্রের সদস্যদের মনোবল চাঙা আর প্রতিপক্ষ লোককে ভয় দেখাতে নিজেকে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘনিষ্টজন বলে জানান দিচ্ছেন।

অভিযোগে আরও প্রকাশ, ডিপিডিসিতে সিদ্ধিরগঞ্জ এনওসিএস (নেটওয়ার্ক অপারেশন এন্ড কাস্টমার সার্ভিস)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ‘র’ (আদ্যাক্ষর) এর দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টি দেদার শুরু হয়। ২০১৬ সালের তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি প্রকল্পে সরবরাহকৃত ৩শ’টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ১৯১টি ট্রান্সফরমারই মানহীন হিসেবে ধরা পড়ে। সেই প্রকল্পের সরবরাহকৃত ট্রান্সফরমারের বিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম আটকে দেয়। এতেই প্রমাণিত হয় তিনি কীভাবে গ্রাহকদের ঠকিয়েছেন। এছাড়া নতুন ভবন নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির মালিকদের জিম্মি করে বৈদ্যুতিক মালামাল সরবরাহ করে আসার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিজের ২য় স্ত্রীকে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে বিদ্যুতের তার, ট্রান্সফরমার, সার্কিট ব্রেকার ইত্যাদি বিক্রয় করে থাকেন। ব্যবসায়ী ও হাইরাইজ ভবনের মালিকদের এক প্রকার জিম্মি করে প্রতি বছর ওই প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যবসায়ী ও হাইরাইজ ভবনের মালিক গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী এইচ-টি (হাই টেনশন-৪৯ কিলোওয়াট তদূর্ধ্ব) সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় নিজস্ব সাব-স্টেশন নির্মাণের কাজ তার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া না হলে এ ধরনের কোনো গ্রাহককেই তিনি সংযোগ প্রদান করতেন না। যা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিধায় একই প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রকৌশলী আবু জাফর দুদকে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। তার দুর্নীতি ও অপকর্ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ পরলেও তার তদন্ত রহস্যজনকভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ থাকা পরও তিনি ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। যার ফলে তিনি নিজেকে দোর্দন্ড প্রতাপশালী মনে করছেন বলেও অভিযোগ।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘অতীতে যা হয়েছে তা বর্তমানে কেউ করতে পারবে না। আমার মন্ত্রণালয়ে কেউ কোনো অপরাধ করে ছাড় পাবে না। যার বিরুদ্ধেই দুর্নীতি পাওয়া যাবে তাকেই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ