বাজারে এক হাজার ৭০০ জেনেরিকের প্রায় ২০ হাজার ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে গেজেটভুক্ত ১১৭টি জেনেরিকের ৪১৭ অত্যাবশকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। অন্যগুলোর বিষয়ে কোম্পানিগুলো কাঁচামাল, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং খরচের বিষয়ে জানিয়ে ভ্যাট প্রদানের নিমিত্তে মূল্য নির্ধারণের জন্য ওষুধ প্রশাসনে দাখিল করে। ওষুধ প্রশাসন যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন করে। এ হিসেবে গেজেটভুক্ত মাত্র ৬.৮৮ শতাংশ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বাকি ৯৩.১১ শতাংশ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম। আর এ কারণে ওষুধের সামগ্রিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে একে সরল অঙ্কে না দেখে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভূমিকায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাত পর্যবেক্ষকরা।
তাদের ভাষ্য, এক সময় দুই শতাধিক ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার, এখন ঠিক করতে পারে মাত্র ১১৭টির। এ ক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু তা মানছে না ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে।’ অথচ আইনের এ ধারা অমান্য করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এতে ওষুধ কিনতে গিয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে জীবনধারণে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। যেমন উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীরই নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। উচ্চরক্তচাপের ওষুধ বিসোপ্রোলল ফিউমারেট ট্যাবলেটের দাম কয়েক মাস আগে ছিল ৬ টাকা। এখন প্রতি পিস ব্রিক্রি হচ্ছে ৮ টাকায়। এমলোডিপাইন শ্রেণির বড়িপ্রতি মূল্য ১৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২১ টাকা। ধরন ও কোম্পানিভেদে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ওষুধের দাম। যা এ খাতের জন্য রীতিমতো ‘অশনিসংকেত’।
যদিও ওষুধ প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের দাবি, ১০০ টাকার ওষুধের মধ্যে ৩৭ টাকার কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ আরও নানা কারণে ওষুধের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে ওষুধের বাড়তি দামের লাগাম টেনে ধরতে গেলে হিতেবিপরীত হবে। তাই তারা সবদিক সামলে চলছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষ্য, ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল সরকারের। কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম সরকারের হাতে এবং বাকিগুলো কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়। তখন থেকেই এ খাতে নৈরাজ্য শুরু হয়। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো ১৯৯৪ সালে নেয়া সিদ্ধান্তের সুবিধা নিচ্ছে। এটা পরিবর্তনে কেউ এগিয়ে আসেনি। যেহেতু সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, তাই ডলারের দামের সঙ্গে ওষুধের দাম বাড়ে। দেশে এপিআই (অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্স) পার্ক চালু না হওয়া পর্যন্ত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে গেজেট প্রকাশ না করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানোটা বেআইনি বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিসংক্রান্ত ১০টি অসংগতি তুলে ধরে ক্যাব জানায়, দেশে উৎপাদিত এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহূত ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। আইন অনুসারে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই এ তালিকার ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ উৎপাদনকারীই এর মধ্যে অল্প কয়েকটি ওষুধ উৎপাদন করে। এই ১১৭টির বাইরে অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা ১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ওষুধের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ডলার সংকট ও আমদানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও অভিযোগ আছে, মূল্য সমন্বয়ে কোম্পানির চাওয়ার প্রাধান্য থাকে বেশি। তাই মানুষের ক্রয় সক্ষমতাকেও বিবেচনায় রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে মানুষের দিকটা দেখার কথা নিয়ন্ত্রকদের। তবে সেটা দেখা হচ্ছে না। দেশে যেসব শিল্প সংগঠন আছে, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তারা যেভাবে প্রস্তাব দেয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা নীরবে মেনে নেয়। এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। ওষুধের দাম যৌক্তিকতার বাইরে চলে যাওয়ায় অনেকে ঠিকমতো ওষুধ কিনতে পারছে না, যার প্রভাব রোগ নিরাময়ে পড়েছে যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওষুধের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ বাড়বে। তবে ডলার সংকটসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বাড়াতে চাইবেন, এটা স্বাভাবিক। কারণ কেউ লোকসান দিয়ে ব্যবসা করতে চাইবেন না। এ জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে উৎপাদন খরচ কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি মনে করেন, প্রচুর ওষুধ কোম্পানি হওয়ায় তারা নিজেদের ওষুধের প্রচার করতে অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করে। তাই কোম্পানিগুলোর পছন্দের তালিকায় চিকিৎসকসহ কিছু বিষয় জড়িত আছে। ওষুধের নির্ধারিত জেনেরিকের সঙ্গে নতুন কিছু সংযোজন করে কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সরকার যদি নির্ধারিত ফর্মূলার ভিত্তিতে দর নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে শৃঙ্খলা আসবে।
এদিকে ওষুধ প্রশাসন যে প্রক্রিয়ায় ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিচ্ছে তা বেআইনি বলে মনে করেন অভিজ্ঞ আইনজীবীরা। তাদের ভাষ্য, আইন অনুযায়ী ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের। তবে দাম বাড়াতে হলে বাজার যাচাই করতে হবে, বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে হবে এবং গণশুনানি করতে হবে। প্রাণরক্ষাকারী অনেক ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ না করে ওষুধ কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে যদি এক টাকাও দাম বাড়ায়, আর সেটা যদি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মেনে নেয়, তা হবে বেআইনি। ওষুধ কোম্পানির প্রস্তাবিত দাম গ্রহণের এখতিয়ার ওষুধ প্রশাসনের নেই- মনে করেন আইনজীবীরা। স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকঋণের সুদ, জ্বালানি খরচ এবং ডলারের চড়া দরের কারণে ওষুধের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে— এ অজুহাত দেখিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে লাগামহীনভাবে ওষুধের দাম বাড়াতে না পারে সে ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আগাম কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। গত দুই বছরে প্রায় সব ধরনের ওষুধের কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির পর ওষুধ কোম্পানিগুলো আরও দাম বাড়ানোর তোড়জোর শুরু করেছে। তাদের সে তৎপরতায় গত দুমাসে নতুন করে বিপুলসংখ্যক ওষুধের দাম বেড়েছে।
তারা বলছেন, এমনিতেই প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকায় বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। তাই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে ধীরে ধীরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে ওষুধ উৎপাদনের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন ভ্যাট, ট্যাক্স কমানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
এদিকে নতুন করে ওষুধের দাম বাড়াতে ওষুধশিল্প মালিক সমিতির নেতারা এরই মধ্যে নানা ধরনের তোড়জোড় শুরু করেছেন। ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দর, জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়া ও কাঁচামাল ক্রয়ে ডলার সংকট ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল মুক্তাদির গণমাধ্যমে বলেন, ‘এখন ডলারের দাম বেড়ে অফিসিয়ালি ১১০ থেকে ১১১ টাকা হয়েছে; আগে যা ছিল ৮৬ টাকা। এর মধ্যেই আমরা ওষুধের জোগান দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ রকম অবস্থায় আর বেশি দিন চলা সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর, যাতে মানুষের জন্য সহনশীল হয়।’ বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘ওষুধের কাঁচামাল কিনতে আমরা এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংক বলছে, আপনারা আগাম টাকা দেন। কেউ ২০ শতাংশ, কেউ ৩০ শতাংশ দিয়েছে। এখন দাম বাড়ানো নিয়ে আমরা নিজেরা আলোচনা করছি। পরে দামের বিষয়টি প্রস্তাব করব।’
ওষুধশিল্প মালিক সমিতির তথ্যমতে, দেশে ২১৩ স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। যারা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে। দেশে ওষুধের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের ১৫৭ দেশে পণ্য রপ্তানি করে। গত সাত বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ