ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

গার্মেন্টের ক্রয়াদেশ হারানোর নেপথ্যে চুরি

প্রকাশনার সময়: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৬

সংঘবদ্ধ চোর চক্রের কারণে গার্মেন্টের ক্রয়াদেশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বায়ারদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতিকে (বিজিএমইএ) চিঠি দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দারা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য ও বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামাল উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ। মালামাল পরিবহনে যুক্ত শ্রমিকরাই এই চক্রের মূল হোতা বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে আজ সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।

গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলকার গার্মেন্ট থেকে কাভার্ডভ্যানে মালামাল চট্টগ্রামের বন্দরে নেয়ার পথে চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। সম্প্রতি রাজধানীর দুুটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনুমানিক ৫০ হাজার পিস গার্মেন্টে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। জার্মানিতে পৌঁছানোর পর ক্রয়াদেশ দেয়া মালের পরিমাণের সঙ্গে দেখা যায় বিস্তার ফারাক।

এরপর ওই দুই বায়ারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতিকে নির্দেশনা অনুযায়ী কম পণ্য দেয়ার অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে কয়েকটি ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়। এরপর অভিযুক্ত ওই দুই গার্মেন্ট মালিকদের ডেকে পাঠানো হয়। তারা বিজিএমইএকে চুক্তি অনুযায়ী সঠিক মাল সরবরাহের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। ইনভয়েস ও চালানের কপিতে উঠে আসে সঠিক পণ্য দেয়ার তথ্য। পরিবহনে যুক্ত কাভার্ডভানের লোকজনও মাল বুঝে নিয়েছে বলে চালানের কপিতে সই করার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষও মালামাল বুঝে পেয়েছে বলে তথ্য উঠে আসে।

বিষয়টি নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েন বিজিএমইএ’র কর্তাব্যক্তিরা। এমন পরিস্থিতিতে তারা গোয়েন্দা পুলিশের শরণাপন্ন হন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। এরপর তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা যায়, কয়েকটি সিএনজি গ্যাস স্টেশনসংলগ্ন অনেক গোডাউন রয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢাকা থেকে মালামাল পরিবহনের সময় এসব সিএনজি স্টেশনে কাভার্ডভ্যানগুলো থামানো হয়। এরপর সেখান থেকে কৌশলে এক একটি লট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর ওই ট্রাম বন্দরে গিয়ে পৌঁছানোর পর বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে মাল বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসে। বন্দর থেকে ওই পণ্য বায়ারের কাছে পৌঁছানোর পর সেখানে অর্ডারকৃত পণ্যের থেকে কম পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে পরিবহনে যুক্ত ব্যক্তিরাই মূলত চুরি চক্রের মূল হোতা।

তিনি বলেন, গাড়ি থেকে মাল সরানোর পর তা স্টক লট হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়েস্টেস হিসাবে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে তা দেশের বিভিন্ন মার্কেটে চলে যায়। থান কাপড়গুলো চলে যায় ইসলামপুরের পাইকারি বাজারে। এই চক্রের কারণে দেশের সুনাম ক্ষুণœœ হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে।

জানা গেছে, গত ১৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানা এলাকা থেকে ৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই গার্মেন্ট মালামালসহ আন্তঃজেলা চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৪)। আটকরা হলো- বরিশালের সিরাজুল ইসলাম, ভোলার মো. জহির, জয়পুরহাটের মো. জনি, রাজবাড়ীর মো. জমির খান, শরীয়তপুরের মো. নুর জামান, নারায়ণগঞ্জের মো. তাবারক হোসেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টন ভর্তি গার্মেন্টসামগ্রী, নগদ ৮২ হাজার টাকা, মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত ২টি কাভার্ডভ্যান, ১টি প্রাইভেটকার এবং ১০টি মোবাইল জব্দ করে র‌্যাব।

এ বিষয়ে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গার্মেন্ট মালামাল বিভিন্ন দেশে রফতানি করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে কিছু কাভার্ডভ্যান থেকে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ দামি গার্মেন্ট মালামাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ ছায়া তদন্ত করে বিষয়টির সত্যতা পায়। র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার তালতলা, ধামগড় এলাকার ওই রি-রোলিং মিলস লির ভেতর অভিযান পরিচালনা করে আনুমানিক ৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই গার্মেন্ট সামগ্রী, আন্তঃজেলা চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধার হওয়া গার্মেন্ট মালামাল সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ শনাক্ত করে।

তিনি বলেন, এ ধরনের আরো একাধিক ব্যক্তির বিষয়ে র‌্যাবের অনুসন্ধান চলছে। তাদের গ্রেফতার করে দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে।

এ ঘটনার আগে গত ১৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ বন্দরে কোটি টাকা মূল্যের গার্মেন্ট তৈরি রফতানিকৃত চোরাই পণ্যের ৩৪১টি কার্টন উদ্ধার করে পুলিশ। নগরীর ২০নং ওয়ার্ড বন্দরের দড়িসোনাকান্দা এলাকার সিরাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে ওই চোরাই মালামাল উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় হাসিব-রাজিব নামে দুই ভাইকে। বন্দর থানার এসআই মোফাছের জানান, কার্টনে ভর্তি গার্মেন্টপণ্য অন্যত্র নিয়ে যেতে ট্রাকে লোড করার খবর পেয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ ৩৪১ কার্টন ভর্তি রফতানিকৃত চোরাই গার্মেন্ট তৈরি পণ্য উদ্ধার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এসআই জানান, রফতানির সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে দীর্ঘদিন ধরেই তারা তৈরি পোশাক চুরি করে আসছিল। যাত্রাপথে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নিজস্ব গোডাউনে নিয়ে কার্টন খুলে সেখান থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়। এ ধরনের কাজে চালককে ২০ হাজার আর সহযোগীকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালক-সহযোগীদের সঙ্গে মিলে রাস্তায় কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে রফতানি পোশাক ও মালামাল চুরি করে আসছিল বলে তারা স্বীকার করেন।

এ ঘটনার পর গত পহেলা আগস্ট নোমান গ্রুপের চুরি যাওয়া ৯০টি কাপড়ের রোল ও কাভার্ডভ্যান উদ্ধারসহ ৩ জনকে গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, চক্রের মূল হোতা আসাদুজ্জামান ওরফে মোল্লা আসাদ, আল আমিন ওরফে সরোয়ার ও আবেদ আলী।

ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গার্মেন্টসের পণ্য চুরি যাওয়ার ঘটনায় সম্প্রতি একটি কমিটি হয়। সেখানে ডিবি পুলিশও রয়েছে। এরপর এসব ঘটনা তদন্তের ধারাবাহিকতায় এই চুরি চক্রকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। নোমান গ্রুপের কাপড় চুরি যাওয়ার ঘটনার দুই দিনের মধ্যেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ধৌর ব্রিজ এলাকা থেকে কাভার্ডভ্যানসহ চালক আসাদুজ্জামান মোল্লা আসাদকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্যে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকা থেকে আল আমিনের গোডাউন থেকে চুরি যাওয়া তোশক ও কাপড়ের ব্যাগ তৈরির কাজে ব্যবহৃত ৮ হাজার ৪৬০ মিটার কাপড় উদ্ধার ও চক্রের অপর দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

হারুন অর রশীদ বলেন, আসাদ কাভার্ডভ্যানচালক হিসেবে বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকরি নেন। গার্মেন্টসের মালামাল পরিবহনের সময় সুবিধামতো সময়ে কাভার্ডভ্যানসহ চুরি করে নিখোঁজ হয়ে যান। পরে আবার অন্য গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে নতুন করে চুরির পরিকল্পনা করেন। আসাদ চুরি করে কাভার্ডভ্যানসহ কাপড়গুলো আল আমিনের গোডাউনে রাখতেন। এরপর আবেদের মাধ্যমে চোরাই বাজারে সেসব কাপড় বিক্রি করা হতো। কাপড়গুলো গ্রেফতার আবেদের মাধ্যমে গাজীপুরের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির পরিকল্পনা ছিল। আসাদের বিরুদ্ধে এর আগেও গাজীপুরের কালিগঞ্জ ও টঙ্গী পূর্ব থানায় মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এমন কর্মকা- দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এটি শিল্পের জন্য কখনোই ভালো হবে না। কারণ এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ম হচ্ছে। এটা চলতে থাকলে ক্রেতারা আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে প্রধান করে বিজিএমইএ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির প্রতিনিধির অনেকে আছেন।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ