দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতাকে গ্রেফতারের পর কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ধর্মভিত্তিক দুই সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। নানা ইস্যুতে বর্তমানে চাপে রয়েছে তারা। পুরোনো মামলা সচল ও নাশকতার বিভিন্ন মামলায় নতুন করে ধরপাকড়ের মুখে পড়ছেন দু’সংগঠনের নেতারা। প্র্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়ায় আতঙ্কে রয়েছে অন্যও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরই মধ্যে পাকড়াও করেছে সংগঠন দুটির শীর্ষ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে। গ্রেফতার নেতাদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচিও দিতে পারছেন না তারা। গ্রেফতারের ভয়ে আছেন অন্যরা। তাই কেন্দ্র থেকেও নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার বার্তা দেয়া হয়েছে। হেফাজত ও জামায়াতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এসব তথ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে জামায়াত থেকে কিছু নেতা বেরিয়ে ‘আমার বাংলাদেশ’ গঠন করে। ‘আমার বাংলাদেশ’ সংগঠন বা হেফাজতে ইসলামকে সামনে রেখে দেশের মৌলবাদীরা সংগঠিত হতে চাইছে। হেফাজত, জামায়াত বা ইসলামী দলগুলো খোলস পাল্টালেও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একই। তারা আসলে সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায় এবং নিজেদের শক্তি দিয়ে সরকারকে ছোবল মারতে চায়। মূলত জামায়াত ও হেফাজত এখন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। এজন্যই এসব সংগঠনের ব্যাপারে সরকারের শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থায় থাকা উচিত। জানা গেছে, হেফাজতের দুই আমির আহমদ শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর সংগঠটি এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। একদিকে দলীয় কোন্দল-গ্রুপিং অন্যদিকে পুরোনো মামলায় নেতাকর্মীদের মাঝে রয়েছে গ্রেফতার আতঙ্ক। আবার একই সঙ্গে আহমদ শফীপন্থিরা হেফাজতকে ভেঙে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন হেফাজত করতে চাইছে। যাতে জুনায়েদ বাবুনগরীপন্থিদের দলে আরো কোণঠাসা করে রাখা যায়। এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এছাড়া চলতি বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে সারাদেশে ১৫৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত মোট আসামির সংখ্যা তিন হাজার ২৭০। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ৮০ হাজারের বেশি। এসব মামলায় সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মামুনুল হকসহ দুই শতাধিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চ থেকে ৫ মাসে হেফাজতের ১৩ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা। তবে নাশকতায় জড়িতদের গ্রেফতারের অভিযান বন্ধ হয়নি। পুরোনো মামলায় এখনও গ্রেফতারের তালিকায় রয়েছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।
সূত্র জানায়, গত মার্চে মামুনুল হকের রিসোর্টকােণ্ডে বিব্রত অনেক নেতা পদত্যাগ করছেন। অন্যদিকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়ার হুমকির পর নড়েচড়ে বসে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালের মে মাসে শাপলা চত্বরে নাশকতা-তা-ব সৃষ্টির মামলায় হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। সামনে আরো নেতা আটক হতে পারেন।
হেফাজতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন রূপে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে। সারাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা। নতুন আমির আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নেতৃত্বেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
হেফাজতের নেতারা বলেন, সংগঠনের মধ্যে এখন বড় ধরনের সংকট চলছে। সারাদেশে সংগঠনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা হবে। হেফাজতে ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। হেফাজতকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের সংগঠনে পরিণত করার চেষ্টা এখনো চলছে। অথচ আল্লামা শফী হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে।
হেফাজতে ইসলামের সাবেক নায়েবে আমির আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী বলেন, মানুষ ভুল করে, আবার শুধরাবার চেষ্টা করে। আমরা আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে পেশ করে এসেছি। হেফাজত তো আগে ভালোই ছিল আল্লামা শফীর (রহ.) সময়। পরে কিছু কার্যকলাপের জন্য সরকার এটাকে অন্য চোখে দেখছে। সরকার আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করছে। সেই কারণে হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান চলছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৯ নেতাকে গ্রেফতারের পর থেকে সংগঠনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রেফতার নেতাদের অনুপস্থিতিতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে হঠাৎ এমন ধরপাকড়ে উদ্বিগ্ন নেতারা কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তারা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিকই যাচ্ছিল। সংগঠনের তেমন কার্যক্রমও ছিল না। বিরোধীপক্ষ এক ধরনের ঘরে বন্দিই ছিল। সংগঠনকে উসকে দেয়ার জন্যই হয়তো এমন ধরপাকড়।
জামায়াত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, নির্বাচনের দাবি অব্যাহত থাকবে। একটি সুদৃঢ় ও কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন তারা।’ তবে নির্বাচনে না গেলেও সাংগঠনিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছিল। একই সঙ্গে সামাজিক কার্যক্রমে জোর দেয় দলটি। শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে তারা গোপনে সারাদেশে সাংগঠনিক কাজ করেন। করোনার মধ্যে তাদের সিদ্ধান্তে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বেশ কয়েকটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয় দলটি। গত জানুয়ারির পর থেকে সাংগঠনিক কর্মকা- আরো জোরদার করে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আলোচনার উদ্যোগের সঙ্গেও একমত ছিল জামায়াত। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতারের পর এখন আবার অন্যদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জামায়াতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন করে এই ধরপাকড়ের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের একটা সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয় নিয়ে সামনে রাজনৈতিক মেরুকরণের সম্ভাবনা আছে। সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও চলছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ গ্রেফতার তাদের জন্য নতুন ধাক্কা। ইসি পুনর্গঠন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জামায়াতকে বাগে আনতে ভেতরে ভেতরে ভিন্ন চেষ্টাও হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ এক সদস্য বলেন, দলের মধ্যে কোনো ভিন্নমত নেই। সিনিয়র নেতাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে এটা ঠিক, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা অনেক সক্রিয় নেতা। দলে তাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে এর একটা প্রভাব পড়েছে- এটাই স্বাভাবিক।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, গ্রেফতারের ঘটনা সরকারের বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। এটা একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এসব করে লাভ হবে না।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে। সরকার দীর্ঘ এক যুগ ধরে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গায়ের জোরে বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। অতীতে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলন দমন করা যায়নি। আগামীতেও যাবে না।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ