ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বরূপে ফেরার চেষ্টায় জঙ্গিরা

প্রকাশনার সময়: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:১৪
সংগৃহীত ছবি

পতনের মুখ থেকে আবারো চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। আগের রূপে ফিরে আসতে পুরোনো ধারার সদস্যদের নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ করছে আত্মগোপনে থাকা নেতারা। এমনকি ঢাকার আশপাশে ঘাঁটি করারও পাঁয়তারা করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যমতে, সম্প্রতি বেশ কয়েক ছাত্রকে হত্যা করার পরিকল্পনাও নিয়েছিল বলে গ্রেফতার এক জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু ধরা পড়ায় তাদের মিশন শেষ হয়ে গেলেও সক্রিয় আছে অন্য জঙ্গিরা। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বিদেশি নাগরিক, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ওপর হামলাসহ নাশকতা চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সম্প্রতি পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, পুরোনো জঙ্গিরা প্রায় কয়েক বছর ধরেই লুট, ছিনতাই ও ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৭-৮টি ডাকাতি ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকাও লুট করেছে। এমনকি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। এসব ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ-জামালপুর উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত রয়েছে। করোনাকালেও অনলাইনে তারা সদস্য সংগ্রহ, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে অনলাইন ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি বোমার সরঞ্জাম কেনে বান্দরবানের গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে জঙ্গি ট্রেনিং নিয়েছে কমপক্ষে শতাধিক তরুণ। সংগঠনকে বিস্তৃত করতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেছে নব্য জেএমবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি সিটিটিসি ও র‌্যাবের হাতে অন্তত ২০ জঙ্গি গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী।

জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সংগঠনিক কার্যাক্রম চাঙ্গা করতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আগের রূপে ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশে প্রথম প্রশিক্ষিত জাবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা নামে এক তরুণী জঙ্গি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তাছাড়া র‌্যাবের হাতে ময়মনসিংহে চার জঙ্গি ও ঢাকার বছিলা জঙ্গি আস্তানা থেকে শীর্ষ জঙ্গি এমদাদুল হককে গ্রেফতারের পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) একটি গাড়িতে পেট্রলবোমা মারতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে দেলোয়ার নামে এক জঙ্গি। তার কাছ থেকে সিটিটিসি তথ্য পেয়েছে, বাংলাদেশে হামলা করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার টার্গেট ছিল তার। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সিটিটিসির উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, দেলোয়ার ‘সেলফ রেডিকালাইজড’। কিছুদিন সে জাপানে ছিল। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগের ভেতরে এক লিটারের বেশি তরল পদার্থ ও দুটি লোহার তৈরি ছুরি ছিল। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেলোয়ার ঠা-া মাথার জঙ্গি। গুলশানে এআইইউবির একটি মাইক্রোবাসে তিনি বোমা মারার চেষ্টা করেছিলেন। পথচারীর সহায়তায় তাকে ধরা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্টাফদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালিয়ে প্রাণহানি ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ছক ছিল তার। অনলাইনে উগ্রপন্থি বিভিন্ন অডিও-ভিডিও দেখতেন দেলোয়ার। কয়েক সহযোগীর নামও বলেছেন দেলোয়ার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশে বড় কোনো হামলা বা নাশকতা ঘটানোর সাংগঠনিক সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেই। তবে সম্প্রতি তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি করে অর্থ জোগান দিয়ে পুরোনো জঙ্গিদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি নব্য জেএমবিকে পুনর্গঠন ও সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থের জোগানে অনলাইনে অ্যাকটিভ রয়েছে জঙ্গিরা। এর আগে তারা রাজধানীর গুলিস্তান, মালিবাগ ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ কয়েকটি বোমা হামলা ও নাশকতার ঘটনাও ঘটিয়েছে। সিটিটিসি ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, এসব হামলা চালিয়ে নব্য জেএমবি তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত তরুণীদের জঙ্গি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষিত করেছে তুলছে। অনলাইন ব্যবহার করে নাশকতার উদ্দেশ্যে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে জঙ্গিরা। উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে তরুণদের জঙ্গিবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা জঙ্গি রিক্রুটমেন্টের সঙ্গে জড়িত আছে, তারা এসব আইডি খুলে জঙ্গিবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ রকম বেশ কয়েকটি ফেসবুক আইডির সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘হোয়াইট হাউসের মুফতি’ নামক একটি উগ্রবাদী ফেসবুক আইডিসহ কয়েকটি আইডির মালিককে খুঁজছে তারা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বছিলার জঙ্গি-আস্তানা থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি জেএমবি শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০০৩ সালে জেএমবির সাবেক শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের বায়াত গ্রহণ করে সে। বছিলায় জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তোলে উজ্জল। জঙ্গিরা লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের ধরতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে।

সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী সুমন জানান, গত ১০ আগস্ট গ্রেফতারকৃত বোমাগুরু ফোরকানসহ চারজন ধরা হয়। তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা ভিডিও দেখে বোমা বানায়। আলোচিত ধর্মীয় বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের ওয়াজ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বান্দরবানের পাহাড়ে হিজরত করে নব্য জেএমবির একাধিক সদস্য। তাদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত তিন যোদ্ধা মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুস সালাম আর মুফতি আবদুল হান্নান শেখ তৈরি করেন হরকাতুল জিহাদ হুজি। ১৯৯৯ সালে হুজি কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে দশজনকে হত্যা করে। হামলা করা হয় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে।

২০০৪ সালের মে মাসে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা চালায় তারা। হুজির সবচেয়ে বড় অপারেশন ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যার পেছনেও ছিল হুজি। তাছাড়া জেএমবি, জেএমজেবিক তৎপরতা ছিল বেপরোয়া।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ আবদুর রহমান এবং বাংলাভাইসহ জেএমবির ৬ নেতাকে ফাঁসি দেয়া হলেও তাদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। বর্তমানে নব্য জেএমবির তৎপরতা আছে। পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহ্রীরও এখনো সক্রিয় আছে। হলি আর্টিজানের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫শ’ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮শ’ জেএমবি সদস্য। আর র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬শ’ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ