ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য

প্রকাশনার সময়: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:০৯
ছবি: সংগৃহীত

খোলা জায়গায় ফেলে রাখা মেডিকেল বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি হাসপাতাল ৬৪৫টি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ৯৪টি রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার মিলিয়ে মোট ১৬ হাজার ৯৭৯টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েকশ’ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদন হয়। তবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক তথ্য নেই কারো কাছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে রাজধানীর চারপাশের নদী, হাসপাতালের সামনের ডাস্টবিন, নর্দমা বা খোলা জায়গায়। যা বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। খোদ রাজধানীর মেডিকেল বর্জ্যরে এমন ব্যবস্থাপনা থেকে সহজেই অনুমেয় করা যায় সারাদেশের প্রকৃত অবস্থা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতাল ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশনের কার্যকর ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশনের মানদ-ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন ও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। ২০০৮ সালে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশন নিয়ে আইন হলেও তা খুবই দুর্বল কিংবা যুগোপযোগী নয়। তাই আইনটি সংশোধন দরকার ও বাস্তবায়নের দাবি জানান বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। তন্মধ্যে অত্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্যরে তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সুচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, টিউমার, ওষুধের শিশি, রক্তের ব্যাগ, স্যালাইনের ব্যাগ, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভৃতি। তাছাড়া পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের সঙ্গে পানির পাইপের সংমিশ্রণেও সংক্রামক রোগের ব্যাপক বিস্তার হয়। এসব বর্জ্যরে বেশির ভাগই সংক্রামক। এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। টাইফয়েড, কলেরা, যক্ষ্মা, আমাশয়, ডায়রিয়া, এইচ আই ভি, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, জন্ডিস, নিউমোনিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারজনিত জটিলতা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাছাড়াও হাসপাতাল থেকে নির্গত পানির মাধ্যমে সালমোনেলা এবং শিগেলা প্রজাতির জীবাণু ছড়ায়। এ বর্জ্য পানিতে বিদ্যমান অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধাতু ও রাসায়নিক উপাদান যেমন ট্রাইক্লোরো ইথিলিন, সিসা, আর্সেনিক, বেনজিন, তামা, জিংক, ক্যাডমিয়াম, নিকেল ইত্যাদি যা চর্মরোগসহ মারাত্মক ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৪০ লাখই শিশু। এই বৈশি^ক পরিসংখ্যানের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাথমিক, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৪৫টি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ৯৪টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলতি বছরে সবশেষ সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ৪ হাজার ৪৫২টি, ক্লিনিক ২ হাজার ২৩৬টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১০ হাজার ২৯১টি আছে। ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে বেসরকারি হাসপাতাল ১ হাজার ১২৫টি, ক্লিনিক ৬৩৩টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১ হাজার ৭৭৮টি সবমিলিয়ে ৩ হাজার ৫৩৬টি। দেশে দুই দশকে হাসপাতাল বেড়েছে চারগুণ, ক্লিনিক সাড়ে তিনগুণ, ডায়গনোস্টিক সেন্টার প্রায় ছয়গুণ। মোট বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা মোট ১৭ হাজার ৭১৮টি। সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৫২ হাজার ৮০৭টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে এক লাখ ৫ হাজার ১৮৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১.৬৩ থেকে ১.৯৯ কেজি চিকিৎসা বর্জ্য উৎপন্ন হয়।

এদিকে, প্রিজম নামক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঢাকায় ১২০০টি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। করোনার আগে এ সংস্থা প্রতিদিন ১৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করত। গড়ে প্রতিটি হাসপাতাল থেকে ১১ দশমিক ৭ কেজি। বর্তমানে প্রতিদিন ৭-৮ টন বর্জ্য সংগ্রহ করছে। অথচ একটি হিসাবমতে ঢাকায় দৈনিক ন্যূনতম ২০৬ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। হাসপাতালগুলো তাদের বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনাও করছেন না। মাঠ জরিপ থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি হয় রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এর পরিমাণ প্রায় ৪৬.৪ শতাংশ। এর পাশাপাশি রয়েছে সাধারণ বর্জ্য ৩১.৯ শতাংশ, ওষুধ জাতীয় বর্জ্য ১৩ শতাংশ, ধারালো বর্জ্য প্রায় ৫.৮ শতাংশ এবং রাসায়নিক বর্জ্য প্রায় ২.৯ শতাংশ। এসব বর্জ্যরে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপারেশন রুম, ওয়ার্ড রুম এবং ল্যাবরেটরি। প্রতিদিন সাধারণ ও বিপজ্জনক মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে আর ‘প্রিজম বাংলাদেশ’ শুধু মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে। তবে সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মেডিকেল বর্জ্য রাখার জন্য খোলা ও অনুপযুক্ত জায়গা ব্যবহার করে। প্রায় ৮৩.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বিপজ্জনক বর্জ্যরে জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা বা নষ্ট করার মতো সুবিধা নেই।

জানা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ- পরিবেশ অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, গাফিলতি ও তদারকির অভাব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে উৎসে বর্জ্য পৃথক্্করণ হচ্ছে না। যদিও বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী পৃথক্করণ বাধ্যতামূলক। এছাড়াও হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। একটি সুষ্ঠু মেডিকেল ব্যবস্থাপনা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে অত্যাবশ্যক। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের কলেবর বেড়েছে, সেইসঙ্গে ডিসপোজিবল একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তাই মেডিকেল বর্জ্য বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে সঠিকভাবে ডিসপোজাল করতে হবে। হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। একই মেডিকেল বর্জ্য বিধিমালা ২০০৮ সংশোধন করতে হবে।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। একটি সুষ্ঠু মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যত অনুপস্থিত। করোনাকালে এই সমস্যা আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান। এই অনিয়ন্ত্রিত মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সামনে আরো মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে বিপর্যয় রোধে যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও একটি কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিদ্যমান আইনটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় না। ঢাকা শহরের বেশকিছু হাসপাতালে মানা হলেও অনেক হাসপাতালে মানা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন এবং প্রিজমের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি থাকলেও চুক্তির বাইরে হাসপাতালগুলোয় এই অব্যবস্থাপনাটা বেশি রয়েছে। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো এ সম্পর্কে কিছুই ভাবে না। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য রাজধানীর চার পাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায় ফেলা হয়। মেডিকেল বর্জ্য ও ওষুধের যেসব কেমিক্যাল থাকে, সেগুলো ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে পানিতে প্রবাহিত হয়। ক্রমাগতভাবে এটি জৈবখাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহে ফিরে আসে। যা প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গবেষণায় এ তথ্য এখন প্রমাণিত। প্রতিটি মহানগরে এবং জেলা ও উপজেলায় যেখানে হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোকে একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ