‘সইমু না আর সইমু না অন্য কথা কইমু না/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/এই জানের বদলে রাখুম রে/বাপ-দাদার জবানের মান...।’—
কী আশ্চর্য বোধ। ভাষা চেতনা। সেই বাহান্ন সালে। ভাবা যায়! বাঙালি বুকের রক্ত ঢালেনি শুধু, গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছিল। কোথায় বরকত কোথায় সালাম/ সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে/যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল/যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/সে জাগে ঘরে ঘরে...। বাংলার প্রতি ঘরে বোনা হয়েছিল একুশের রক্তবীজ। বায়ান্নর সে বীজ থেকে আজকের বাংলাদেশ।
আজ বুধবার, মহান সেই অর্জনের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন।
বায়াত্তরের ভাষা আন্দোলন পদার্পণ করল ৭৩ বছরে। মাথা নত না করার অমর একুশে আজ। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...।’
রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে শোক। ভাষা শহিদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। একই সঙ্গে ওড়ানো হবে কালো পতাকা। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ। নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রাম হিসেবেও এর রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। অমর একুশের দিনে পাকিস্তানিদের সবচেয়ে ভালো চিনতে পেরেছিল পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনগণ। তাদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না—বুঝতে পেরেছিল। তাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা জোগায়।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল ভারতবর্ষ। একটি ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র হয় তখন। পাকিস্তানও ছিল দুই অংশে বিভক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঙালি। মাতৃভাষা বাংলা। পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশতু, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালির অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন— ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি...।’ কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সব অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে যায় বাংলার মানুষ।
বাঙালির সে সময়ের আবেগ অনুভূতি ব্যাখ্যা করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা,/তাই কি হয়?’ এর পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। এ অবস্থায় বাঙালির সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সব ভয় জয় করে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। তখন কে ভেবেছিল, মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবি তোলায় ছাত্রদের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালাবে নিজ দেশেরই পুলিশ! অথচ তাই হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি...।’ মায়ের ভাষার জন্য বিরল রক্তস্রোত। সেই রক্তস্রোতে রাজপথ ভেসে গিয়েছিল। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে কাজ হয় না কোনো। কোথায় বরকত কোথায় সালাম/সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে।/যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল/যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/সে জাগে ঘরে ঘরে...। বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে অমর একুশে।
আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ উদযাপন করবে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে। মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবারকার শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার দিবসের অনুষ্ঠানমালা।
‘তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা...।’— মায়ের মুখের সেই বুলি আর ভালোবাসা আক্রান্ত যখন, তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল বাঙালি। আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে এসেছিল বাংলা মায়ের বিক্ষুব্ধ সন্তানরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মুখর ছাত্রদের রুখে দিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছিল পুলিশ। বরকত সালাম রফিক শফিক জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেক শহিদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা। সেই থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কানাডা প্রবাসী সালাম ও রফিকসহ কয়েকজন বাঙালি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ