আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আছে বিশ্বমানের ভাষা জাদুঘর এবং ভাষা আর্কাইভ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষার বর্ণলিপি, উৎপত্তি, ইতিহাস সংরক্ষিত আছে এখানে। অথচ প্রচারের অভাবে দর্শনার্থীদের তেমন আনাগোনা নেই।
সম্প্রতি সরজমিন ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারে বিভিন্ন দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে ঝুলছে প্রাচীন মিসরীয় ভাষার লিপি, চার হাজার বছর আগের গুহাচিত্রের প্রতিলিপি। তবে সাজানো গোছানো আলোকোজ্জ্বল জাদুঘরটি প্রায় নির্জন। এসব দেখার জন্যও তেমন কোনো দর্শনার্থী নেই! আর এ জন্যই বোধহয় বিশাল কক্ষের জাদুঘর পরিদর্শনে আসা দর্শনার্থীদের জন্য নেই সঠিক নির্দেশনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন, ভাষা জাদুঘরে মোট ১৯৯টি দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর তথ্য রয়েছে। এখানে পৃথিবীর ১৯৯টি দেশের ভাষার নমুনা, জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত ও ছবি রয়েছে। জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত। দেশগুলোর নামের বাংলা বর্ণ ক্রমানুসারে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। জাদুঘরের আরও আধুনিকায়নের কাজ চলছে।
ইনস্টিটিউটের আইনে উল্লিখিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশের আদিবাসীদের নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা করা। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর অবস্থান চিহ্নিত করা এবং তাদের ভাষিক পরিস্থিতির বাস্তব পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই এ সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
সমীক্ষার কার্যক্রম শেষ হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি বড় কাজ হলো ‘বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’। এটা ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় ৪১টি ভাষা শনাক্ত করা হয়েছে।
এই ৪১টি ভাষার মাত্র আটটি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে। এ ক্ষেত্রে যে ভাষাগুলোর লিপি নেই, সেই ভাষার লিপি তৈরি ও প্রবর্তন করা ইনস্টিটিউটের কাজ। এর পরের কাজ হলো বিপন্ন ভাষাগুলোর শব্দ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পরিভাষা তৈরি করা। ভাষা মাত্রই ব্যাকরণ আছে। লিপি তৈরির পরের কাজ সেই ভাষার ব্যাকরণ এবং অভিধান রচনা করা। অভিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিধান রচনা করলে ভাষা বেঁচে থাকে। এই কর্মপ্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এরপর রয়েছে পাঠ্যপুস্তক রচনা ইত্যাদি।
এ ছাড়া বাংলাদেশে আরেক ধরনের ভাষা আছে। এগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্ষুদ্র। যেমন বেদেদের ভাষা। বেদে জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে তার নাম ‘ঠার’। এ ছাড়া আছে ডোমদের ভাষা। একে বলে ‘ডোম ভাষা’। বেদে ও ডোমদের অনেকেই মাতৃভাষা পরিবর্তন করে বাংলায় চলে এসেছেন। তাদের ভাষাও সংরক্ষণের কাজ চলছে। আবার আইন অনুযায়ী ইনস্টিটিউটের এক নম্বর কাজ হলো দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইনস্টিটিউট এক্ষেত্রে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো আন্তর্জাতিকমানের। আবার ইনস্টিটিউটের যা অর্জন তাকে ‘যথেষ্ট’ বলেই মনে করেন এর মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ। তার মতে, কেবল ভাষাচর্চার জন্য বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি সন্তোষজনক। পর্যাপ্ত জনবল ও কারিগরি সুবিধা থাকলে কাজের গতি আরও বাড়ত।
জানা গেছে, ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। এরপর বিশ্বের বিপন্ন ও প্রায় বিপন্ন ভাষার বিকাশ এবং এসব ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর পল্টনের এক জনসভায় এ সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন বর্তমান এবং ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে ঘোষণা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর ১/ক সেগুনবাগিচায় ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। সে সময় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১২তলা ভিত্তির ওপর তিনতলা ভবন উদ্বোধন করেন। ইনস্টিটিউট পরিচালনার জন্য একই বছরের ১১ অক্টোবর প্রণয়ন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন।
ওই আইনে ইনস্টিটিউটের মোট ২৩টি সুস্পষ্ট দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটিই হলো দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা, বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে প্রচার, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অভিধান বা কোষগ্রন্থ প্রকাশ ও হালনাগাদকরণ, বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও হালনাগাদকরণ এবং ভাষা জাদুঘর তথ্য সমৃদ্ধকরণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা ইত্যাদি। এর মধ্যে ২০১১ সালে ইনস্টিটিউটির প্রথম তলার একটি কক্ষে শুরু হয় ভাষা জাদুঘরের কার্যক্রম।
সূত্র মতে, ২০১১ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। পৃথিবীর সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। তখন থেকে সক্ষমতার অভাবে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি ইনস্টিটিউট। অন্যদিকে যে গবেষণার কাজ আছে সেগুলোও তেমন একটা প্রকাশ হয় না।
আন্তজার্তক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আর্কাইভে ১৫৩টি ভাষার বর্ণমালা আছে। ১৫টি ভাষার চারুলিপি আছে। জানা গেছে, দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিজ্ঞান পড়ানো হয়। অথচ এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই জানেন না এরকম একটি জাদুঘর এখানে আছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, আমাদের জানতে ইচ্ছে করে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি কয়টি দেশে উদযাপিত হয়। কারণ জাতিসংঘ ঘোষিত দিবস কোনো দেশ সাড়ম্বরে পালন করে, কোনো দেশে তা নীরবে চলে যায়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ও বাংলাভাষী অঞ্চলের বাইরে এটি পালিত হয় বলে আমার জানা নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রচারে ইনস্টিটিউট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বিদ্যমান জনবল কাঠামোয় বিশ্বের কোন কোন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় সেই খোঁজ রাখা ইনস্টিটিউটের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, কেবল ভাষা নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গোটা বিশ্বে হাতেগোনা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আটটি মাত্র দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সবই গবেষণামূলক এবং ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল লোকজনই এসবের সঙ্গে যুক্ত।
তাছাড়া এখন ইউনেস্কোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনস্টিটিউটের তরফে বিধিবদ্ধ কাজের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সীমিত। জানা গেছে, ভাষা জাদুঘরে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিমাসে দর্শনার্থী গড়ে মাত্র ১০ জন। গবেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের এখানে আনার জন্য ইনস্টিটিউটের বড় উদ্যোগের দরকার। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। অপরদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রচারের জন্য তারা কাজ করছেন। সেই সঙ্গে ভাষা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাও করছেন তারা। পাশপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষা সফর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে করার আহ্বানও কর্তৃপক্ষের।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ