ঢাকা, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রামে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের জিম্মি করে রমরমা কোচিং বাণিজ্য!

কয়েক ব্যাচ পড়িয়ে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করেন শিক্ষকরা
প্রকাশনার সময়: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০৬

সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানাবিধ নিষেধের পরেও চট্টগ্রামে বন্ধ হচ্ছে না কোচিং বাণিজ্য। শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে সঠিকভাবে পাঠদান না করায় শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে কিংবা কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকটা শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের জিম্মি করেই শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছেন।

চকবাজার, দেওয়ানহাট, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকদের নামে শতাধিক কোচিং সেন্টার রয়েছে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেতন ভোগ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখ হয়ে পড়ছে।

অপরদিকে নগরীর ব্যস্ততম গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মুল সড়কের আশেপাশের এই সব ব্যাঙয়ের ছাতার মত গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারের কারণে সকাল-সন্ধ্যা সড়কে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ পথচারীদের।

সরেজমিনে, নগরীর কলেজিয়েট স্কুলের পিছনে উত্তর নালাপাড়া মনিকা ফার্মেসির সামনে শামশুল উকিলের বিল্ডিং এর চতুর্থ তলায় ২০ হাজার টাকায় পুরো ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে পড়ানো হয় বিভিন্ন স্কুলের তিনশতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। সপ্তাহে তিনদিন করে ৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণী ও এসএসসি পরীক্ষার্থী নিয়ে রুটিন করে সারাদিন এবং রাত আটটা পর্যন্ত চলে এ শিক্ষা কার্যক্রম।

এদিকে নগরীর হালিশহরে সেঙ্গুইন প্লাস, প্রফেসরস পয়েন্ট, এইচ এইচ স্টাডি জোন, প্যারাগণ কোচিং, সৃজন কোচিং, গোল্ডেন প্লাস কোচিং, সেঙ্গুইন প্লাস কোচিং,উল্লাস কোচিং সেন্টারসহ আরো অনেক কোচিং সেন্টার রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের ডে শিফটের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক শাহেদ স্যার; তাকে প্রায় সময় বেলা দুইটার পর থেকেই কোচিং বাণিজ্যে দেখা যায়। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই শিফট স্কুলে সকালের শিফট শেষ হয় সাড়ে এগারোটায় এবং ডে শিফটের সময় এগারোটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত। অর্থাৎ, এ সময়ে স্কুলে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে এই শিক্ষক কোচিংয়ে সময় কাটান।

এ ব্যাপারে তাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করলে স্বাভাবিকভাবেই বলেন, ‘আমার ক্লাস নেই তাই চলে এসেছি।’

জানা গেছে, প্রতিজন শিক্ষার্থী থেকে মাসে ১২০০ টাকা অগ্রিম নিয়ে পড়ান এই শিক্ষক। যেখানে অন্যান্য শিক্ষকরা মাস শেষ হলেই পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ফি নিয়ে থাকেন। এসব ফি ঠিকমত আদায় করতে একজন কেরানিও রেখেছেন শাহেদ স্যার। স্কুলের সরকারি বেতন ছাড়া তার কোচিং থেকে মাসিক আয় আনুমানিক তিন লক্ষ টাকা।

এদিকে নগরীর হালিশহর হাউজিং এষ্টেট বিডিআর মাঠ সংলগ্ন মাইনুর স্যার দ্বারা পরিচালিত প্রফেসরস পয়েন্ট কোচিং সেন্টার ৫ম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তিন শতাধিক শিক্ষার্থী কোচিং করে। গড়ে ভর্তি ফি ১৭০০ টাকা করে আদায় করেন তিনি। মাসে অন্তত ৫ লক্ষ ১০ হাজার টাকা আয় করলেও ট্রেড লাইসেন্স ও ভ্যাট চালান দেখাতে পারেননি এই শিক্ষক।

এ বিষয়ে প্রফেসরস পয়েন্টে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে প্রতিবেদককে লাঞ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে কিছু করতে পারবেন না। আপনাদের মতো অনেক সাংবাদিক আমাদের এখানে নিয়মিত এসে টাকা পয়সা নিয়ে যায়।’

এদিকে হালিশহর এবং বাদামতলী মোড়ে অবস্থিত এইচ এইচ স্টাডি জোন ও প্যারাগণ ভর্তি কোচিং সেন্টার নামে পরিচালিত হচ্ছে দুটি কোচিং সেন্টার। এইচ এইচ স্টাডি জোন বিগত তিন বছরের অধিক সময়ে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অবৈধভাবে কোচিং সেন্টারের নামে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তা মো. ইয়াসিন।

এইচ এইচ স্টাডি জোন কোচিং সেন্টারে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ১৫০ জন। প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বেতন, ভর্তিসহ ফি ২৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এতে পৌনে চারলক্ষ টাকা মাসিক আয় করেন মো. ইয়াসিন। হাজার টাকা আয় করলেও কোনো ট্রেড লাইসেন্স না করে ও সরকারি ভ্যাট না দিয়ে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ সময় প্রতিবেদককে এইচ এইচ স্টাডি জোনের পরিচালক ইয়াসিনের কাছে ট্রেড লাইসেন্স ও ভ্যাট চালান দেখতে চাইলে দেখাতে পারেননি মো. ইয়াসিন।

একই ভবনের ২য় তলায় ও তৃতীয় তলায় বিশাল ফ্লোর ভাড়া নিয়ে সাইন্স কেয়ার নামে রমরমা কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন ড.মাসুদ।

স্থানীয়সূত্রে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই কোচিং সেন্টারে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক বেতন ও ভর্তিসহ আড়াই হাজার টাকা করে নেন ড. মাসুদ। আর এ থেকে তার মাসিক আয় ১০ লক্ষ টাকা।

ড.মাসুদ ২০১৭ সাল থেকে অবৈধভাবে কোচিং সেন্টার পরিচালনার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় করলেও কোনো ট্রেড লাইসেন্স ও সরকারি ভ্যাট না দিয়ে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। গোপনসূত্রে আরও জানা যায়, ড.মাসুদ জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ।

হালিশহরে আরও দুটি কোচিং সেন্টারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেলোওয়ার্স কোচিং ও জেপি কোচিং সেন্টার সরকারি নিয়ম কানুন মেনে এবং ট্রেড লাইসেন্স ও ভ্যাট চালানসহ সকল কাগজপত্র ঠিক রেখে প্রতিষ্ঠান চলমান রেখেছে।

উল্লেখ্য, নগরীর উত্তর নালাপাড়া এলাকায় চট্টগ্রামের বেশিরভাগ নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে বেশিরভাগ কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। ওই এলাকার বিভিন্ন ভবনে রুম ভাড়া নিয়ে এসব কোচিং সেন্টার চলছে।

কলেজিয়েট স্কুলের পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি সরকারী বালিকা বিদ্যালয়। চট্টগ্রাম সিটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি স্যারের রয়েছে স্কুলের পিছনে উত্তর নালাপাড়া এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন কোচিং সেন্টার যেখানে চকবাজারের চেয়ে বেশি কোচিং বাণিজ্য হয়।

অপরদিকে নগরীর চকবাজার শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হওয়াতে এটা সকলের নজরে আসলেও উত্তর নালাপাড়া এলাকা ভিতরে হওয়ার কারণে প্রশাসন, মিডিয়া ও সচেতন নাগরিক সমাজের নজরে তেমন আসেনা।

ফলে বছরের পর বছর এখানে প্রকাশ্যে চলছে কোচিং বাণিজ্য। স্কুলগুলোর পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও কয়েকটি প্রাইভেট কলেজ। তবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর সমাগম কলেজ শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারগুলোতে। একেক বিষয়ে একেক শিক্ষকের চাহিদা রয়েছে শিক্ষার্থীদের কাছে।

জানা যায়, ব্যাচে বা কোচিংয়ে পড়িয়ে অনেক অভিভাবক গর্ববোধ করেন। সন্তান একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ছে- এটা প্রচার করে বেড়ান তারা। এর ফলে অন্য অভিভাবকরা বিভ্রান্তিতে পড়েন। তারা ভাবেন তাদের সন্তান বুঝি পিছিয়ে পড়ল। এভাবেই বাড়ছে কোচিং প্রতিযোগিতা। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্তে¡ও অনেকেই সন্তানকে কোচিং বা ব্যাচে দিচ্ছেন।

নগরীর হালিশহর এ-বøক এলাকার বাসিন্দা নুর ইসলাম বক্কর নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘সন্তানরা বিভিন্ন কলেজ শিক্ষকের কাছে জিম্মি। যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের অনেক বেশি নম্বর দেন শিক্ষকরা। আর যারা ওইসব স্যারের কাছে পড়ে না তাদের কম নম্বর দেওয়া হয়। আরেকজন অভিভাবক এই প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করে জানতে চান- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজিয়েট স্কুলের সুশান্ত স্যার তো একজন মানুষ! উনি বা আরো যারা আছেন টাকার জন্য সকাল থেকে টানা রাত আটটা পর্যন্ত শুধুই কোচিং করান; উনাদের মাথা শরীর এগুলো কি কম্পিউটার? এতোক্ষণ কিভাবে টানা একজন মানুষের পক্ষে প্রাইভেট পড়ানো সম্ভব?সরকারি নিয়ম বা ডাক্তারি মতে একজন মানুষ কতোক্ষণ পড়াতে পাড়েন?এইগুলো শুধুই আমাদের অভিভাবকদের ধোঁকা দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন”।

এইরকম কয়েকজন অভিভাবকের কথাশুনে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে নগরীর উত্তর নালাপাড়া ও হালিশহরে অবস্থিত কয়েকটি কোচিং সেন্টারে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আসলেই সচেতন অভিভাবকদের কথাই সত্য! কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কিছুই বুঝিয়ে দেওয়ার সময়, পরিবেশ কোনটিই নেই এখানে। এক ব্যাচে ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী স্কুলের ক্লাসের মতো। এখানে কিভাবে কাকে কে বুঝিয়ে দিবেন- তা নিয়ে থেকে যায় প্রশ্ন। দেখা যায়, স্যার শুধুই বোর্ডে লিখে যাচ্ছেন, আর ছাত্ররা এইগুলো দেখে দেখে খাতায় লিখে নিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শান্তি ও আনন্দ। কারণ, স্যারের প্রাইভেট খাতায় নাম থাকলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অন্ততপক্ষে পাওয়া যাবে। আর কেউ কেউ ধারণা করছেন এখানে কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত স্যাররাও কোন একটি সিন্ডিকেটে জড়িত আছেন।

পারস্পরিক কথাবার্তা বলে একজন ছাত্র-ছাত্রীকে আরেকজনের চেয়ে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার একটি কৌশল অবলম্বন করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রধান জনাব মুজিবুর রহমা বলেন, ‘কোচিংনির্ভর পড়ালেখা থেকে বের হওয়ার জন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। স্কুলগুলোতে ঠিকমতো শিক্ষকরা পাঠদান করছেন কিনা, সে ব্যাপারে স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের তদারকি করতে হবে। এগুলোর অভাবে নগরীর অলিতে-গলিতে অসংখ্য কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। তবে এসব কোচিং সেন্টারের তালিকা বোর্ডের কাছে নেই। আপনারা ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াতে তুলে ধরুন বা ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের জানান,আমরা সরকারী বিধিমতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ