ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ধুলার নগরী ঢাকা রাতে দূষণ বেশি

প্রকাশনার সময়: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:০৬
সংগৃহীত ছবি

রাজধানীতে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। অফিস-আদালত চালু থাকায় প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় বাড়ে দূষণ। আর মধ্য রাতে দূষণ থাকে সবচেয়ে বেশি। গত পাঁচ বছরে দূষণের মাত্রা বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ২০ ভাগ। যা ঢাকার বাতাসকে করেছে আরো বেশি বিষাক্ত। ঢাকার আকাশে প্রতিদিন উড়ছে অন্তত ২ হাজার টন ধুলা। মূলত সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও মেগা প্রকল্প উন্নয়ন কাজে বেড়েছে দূষণ। মানা হচ্ছে না নির্মাণবিধি। এতে বাড়ছে রাজধানীবাসীর শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ। উন্নয়ন কাজে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করায়, পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা সড়কের আশপাশে চলছে ভবন নির্মাণের কাজ। ফলে এখানকার বাতাসে দেখা দিয়েছে অতিরিক্ত ধুলার উপস্থিতি। ধুলার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে পথচারীরা। একই পরিস্থিতি উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে আব্দুল্লাপুর সড়কের। তাছাড়া মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস নির্মাণ কাজসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বায়ুদূষণ মূলত এসব কারণে বাড়ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানুষের গড় আয়ু বাড়বে সাড়ে ৫ বছর বলছে গবেষকেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা, শহরের মধ্যে মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে ঢাকার আকাশে কখনো নির্মল বাতাসের দেখা মেলে না। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ শহরের একটি ঢাকা। মাঝে মাঝেই বেইজিং ও দিল্লিকে ছাপিয়ে সবার উপরে উঠে আসে ঢাকার নাম। ঢাকায় গত ১৬ বছরে মাত্র কয়েকদিনের জন্য নির্মল বাতাস পাওয়া গিয়েছিল এ বছরে জুলাই মাসে। আর সেটি সম্ভব হয় শুধু লকডাউন ও ঈদের ছুটির কারণে। জুলাই মাসে ঢাকায় বায়ু মান মাত্রা ছিল ৩১.৩১ মাইক্রো গ্রাম পিএম ২.৫।

সূত্রমতে, এক সময় ঢাকায় বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ইটের ভাটা থেকে প্রায় ৫৮ ভাগ। তবে এখন ইটের ভাটার দূষণকেও ছাপিয়ে গেছে নির্মাণ এবং গাড়ির ধোঁয়া। সড়ক নির্মাণ ও মেগা প্রজেক্টের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে প্রায় ৩০ ভাগ। ইটের ভাটা থেকে ৩০ ভাগ, যানবাহন থেকে ১৫ ভাগ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৯ ভাগ দূষণ হচ্ছে। এ বছর মার্চে বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। ডাব্লিউএইচওর মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকলে তাকে সহনীয় বলা যেতে পারে। সেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া ও আফগানিস্তানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল ৭৭ থেকে ৪৭ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে।

জানা গেছে, প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছর থেকে ১০ থেকে ২০ ভাগ বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের বাতাসে গড় ধূলিকণার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম। যা পরিবেশ অধিদফতরের আদর্শ মানের সাড়ে ৫ গুণ বেশি। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ এর জানুয়ারিতে দূষণ বেড়েছে ২৫ ভাগ। ফেব্রুয়ারিতে এটি বাড়ে ১০ ভাগ, মার্চ মাসে ৩৬ ভাগ। শুধু জুলাই মাসেই গত বছরের তুলনায় দূষণ ১০ থেকে ১২ ভাগ কমছিল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, দূষণের একটি বড় কারণ অনিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানা। এ ছাড়া পানি ছিটানো, ইটভাটা বন্ধ করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণ করার পাশাপাশি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

জানতে চাইলে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের বড় কারণ রাস্তার ধুলা, খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণকাজ, কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় ফেলে রাখা ও খোলা অবস্থায় পরিবহন। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ময়লা পোড়ানো। যা পাড়ামহল্লায় বায়ুদূষণের এটি অন্যতম কারণ।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে থেকে বায়ু দূষণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চের আগ পর্যন্ত দূষণ ক্রমাগত বাড়ছিল। তবে মার্চের মহামারির কারণে এই মাত্রা কিছুটা কম ছিল। ২০১৬-২১ সাল পর্যন্ত ঈদ ঘিরে মোট ৫০ দিন ঢাকায় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫০ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৬ দিন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করে। তবে এ বছর আবার বায়ুদূষণ বাড়ছে। সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি এই চার মাস প্রায় ৭০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আর জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই চার মাসে মাত্র ১০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়। শুষ্ক মৌসুমে যদি দূষণ কমিয়ে আনতে পারি তাহলে একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারব।

বায়ু দূষণের আরেকটি উৎসের কথা উল্লেখ করে আহমদ কামরুজ্জামান আরো জানান, সেটি হলো আন্তঃদেশীয় দূষণ। এক দেশের দূষিত বায়ু আরেক দেশে দূষণ ঘটায় বায়ুপ্রবাহের কারণে। ঢাকায় আন্তঃদেশীয় কারণে ১০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলছে কিন্তু নির্মাণবিধি মানা হচ্ছে না। নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ওপর থাকা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। তবে মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দূষণের মাত্রা কমবে।

কখন বেশি দূষণ হয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ঢাকায় দিনের চেয়ে রাতে দূষণ বেশি থাকে। সকালে অফিস আদালত চালু হয়, তখন দূষণ বাড়ে। আবার দুপুরে কমে। সন্ধ্যায় আবার বাড়ে। তবে মধ্যরাতে দূষণ থাকে সবচেয়ে বেশি। মধ্যরাতে দূষণ বাড়ার কারণ এ সময় আন্তঃজেলা বাসগুলো শহরের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। নির্মাণ সামগ্রী ট্রাকগুলো রাতে পণ্য পরিবহন করে। দিনের বেলায় গাড়ির গতি কম থাকায় রাস্তার ধুলা কম ওড়ে। রাতে এটা বাড়ে।

তিনি বলেন, শীতকালে ১০ থেকে ২০ ভাগ দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। বর্ষার সময় কিছুদিন মাত্রার মধ্যে দূষণ থাকলেও বাকিটা সময় দূষিত থাকে।

অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া আসে। আশপাশের কারখানা, নির্মাণকাজ আর ময়লা-আগুন থেকেও ধোঁয়া আসে। ফলে, আমরা যদি পদক্ষেপ নেই তাহলে নির্মল বাতাস আশা করতে পারি। পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের চেয়ে বেশি দূষিত ছিল। ৭০-৮০ বছর আগে আমেরিকায়-লন্ডন-জাপানের অবস্থা আমাদের মতো ছিল। এখন আমাদের চেয়ে শীতকালে ১০০ গুণ কম থাকে তাদের দূষণ।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, দূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা। পোড়ানো ইট দিয়ে সরকারি নির্মাণকাজ না করার নির্দেশনা রয়েছে। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ ও মেগা প্রজেক্টের কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে। ফলে ২০২৩ সালের পর বায়ু দূষণের মাত্রা কমে আসবে।

তিনি বলেন, ইট থেকে সরে আসার চেষ্টা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে রাস্তা ছাড়া সব নির্মাণ কাছে হবে পরিবেশবান্ধব ব্লক দিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাব আমরা। দেশে এখন ৮ হাজার ইটভাটা আছে তবে কমে আসবে আগামীতে। আশা করছি, ২০৩০ সালে ইটভাটা ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে পারব।

জিয়াউল হক আরো বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২১ তৈরি করা হয়েছে। আগামী মাসে এটা পাওয়া যাবে। সেখানে অনেক কিছুই সংযুক্ত করা হবে। সেখানে নির্মাণ বিধিমালা না মানার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মোবাইল কোর্ট করা যাবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ