উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ নিতে পারেনি সরকার। করোনার টিকা কেনা ও স্বাস্থ্যের নানা সমস্যার মধ্যেও বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পায়নি। তারপরও সমস্যা সমাধানে এই করোনাকালেও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি সরকারকে। মহামারির মধ্যে টানা দ্বিতীয় অর্থবছরে বাংলাদেশের অনুকূলে ৭০০ কোটি (৭ বিলিয়ন) ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেছে দাতারা। ২০২০-২১ অর্থবছরে (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২১) ৭১০ কোটি ৬ লাখ ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অর্থ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৭২৭ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
ওই দুই অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরেও বিদেশি ঋণের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার বা ৬৫৪ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দাতাদের কাছ থেকে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
বিদেশি ঋণের এই গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, এই মহামারিকালে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণ-সহায়তা পেয়েছি আমরা। চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার জন্যও মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়া গেছে। এখনো পাওয়া যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রয়োজনের কথা সঠিকভাবে দাতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলাম। সে কারণেই তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আর এই ঋণ-সহায়তা এবং আমাদের সরকারের ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব যতটা পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি। সব মিলিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা মহামারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করে চলেছি। মাঝে টিকা নিয়ে একটু সমস্যা থাকলেও এখন আর নেই। প্রচুর টিকা আছে, আরো আসছে। টিকার আর কোনো সংকট হবে না। আর টিকা কিনতে অর্থেরও কোনো সমস্যা হবে না।’
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘করোনার কারণে সরকারের খরচও কম হয়েছে। গত অর্থবছরের বাজেটের ২৫-২৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়নি। এ অবস্থায় আশানুরূপ ফরেন এইড সরকারকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে। অতিমারির মধ্যেও সরকারকে অর্থসংকটে পড়তে হয়নি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে। টিকা প্রদানও এখন ভালোভাবেই চলছে।’
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করা অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর বলেন, ‘করোনার তৃতীয় ঢেউ যদি না আসে, তাহলে এই অতিমারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পারব বলে মনে হচ্ছে। একটু সময় লাগলেও অর্থনীতি ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। তবে যে কথাটি আমি বারবার বলে থাকি, আবারও বলছি, রাজস্ব আদায়ের দিকে আরো বেশি জোর দিতে হবে। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। বর্তমানের ৯ শতাংশ থেকে তা কমপক্ষে ১২-১৩ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হবে না।’
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব পিয়ার মোহাম্মদ বলেন, মূলত কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে গত অর্থবছর বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর পরামর্শকসহ বিদেশি জনবলের কাজে যোগ দিতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের গতি ধীর হচ্ছে। ফলে অর্থছাড়ও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭১০ কোটি ডলারের যে ঋণ-সহায়তা পেয়েছে, তার মধ্যে ঋণ হচ্ছে ৬৭৭ কোটি ২১ লাখ ডলার। আর অনুদান ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার।
এদিকে গত অর্থবছরে সরকার দাতাদের কাছে পুঞ্জীভূত পাওনা থেকে পরিশোধ করেছে ১৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। সে হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের নিট বিদেশি উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ হচ্ছে ৫২০ কোটি ডলার। চলমান প্রকল্পগুলোর বাইরে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, জাইকা, এআইআইবিসহ অন্য কয়েকটি সংস্থা খুবই কম সুদে টিকার জন্য মোটা অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে গত জুনে এডিবি দিয়েছে ৯৪ কোটি ডলার। গত ২৪ আগস্ট ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে আইএমএফ। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ৫০ কোটি ডলার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ টিকা কিনতে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। অন্য দাতা দেশ ও সংস্থা টিকা কিনতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ