আত্মরক্ষার নামে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে গুপ্তচরবৃত্তির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দেশটির বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে। সূত্র বলছে, সীমান্তে কিছু গোপন এলাকা আছে। সেই সম্পর্কে তথ্য নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিচ্ছে এমন সচিত্র প্রতিবেদন বিশ্বের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনা মিয়ানমারের ছিল। সম্প্রতি মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বাড়ছেই।
অভিযোগ উঠেছে, এ পর্যন্ত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৩২৯ জন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। এর মধ্যে মিয়ানমারের কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আত্মরক্ষার্থে প্রবেশ করেছে। ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিয়ানমারের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে আশ্রয়গ্রহণকারীদের মধ্যে গোয়েন্দাদের পাশাপাশি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির সশস্ত্র সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য, কাস্টমস ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা রয়েছেন। তাদের নিরস্ত্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম ও ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে তারা এসেছে। মিয়ানমারের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা ৩২৯ জনকে নৌপথে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দুই পক্ষের আলোচনার প্রেক্ষাপটে তাদেরকে কক্সবাজার থেকে গভীর সমুদ্রপথে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বিজিপি ও সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্যকে ফেরত পাঠাতে তুমব্রু সীমান্ত এলাকা থেকে বিজিবির সহযোগিতায় টেকনাফে স্থানান্তর করা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে একটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর মিজোরামে পালিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমারের ১৮৪ জন সৈন্য। ভারত সঙ্গে সঙ্গে তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বিদ্রোহীরা বিজিপির একটি ফাঁড়ি দখল করে নিলে পরদিন সকালে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৪ সদস্য। এরপর থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩২৯ জনে পৌঁছেছে। অনেকে আহত হয়ে এসেছেন। তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, জামা-কাপড় দেয়া হয়েছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড় একটা অংশই পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। সীমান্তের এসব এলাকায় লাখের কাছাকাছি বাসিন্দা রয়েছেন। ওপারে গোলাগুলিতে তারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কেউ যেন কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাতে না পারে সেজন্য বিজিবিসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেবেন না তারা। সাধারণ মানুষের মতো মিয়ানমার থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, সীমান্তে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। প্রত্যেকে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছেন। আলী কদম সীমান্ত পুরোপুরি সুরক্ষিত রয়েছে। কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আর প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট ইতোমধ্যে তারা দখল করে নিয়েছে। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।
স্বস্তির খবর পেলেন রোহিঙ্গারা
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনে ওপার থেকে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বার্তা আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এসব বার্তা পাঠাচ্ছে বলে এপারে থাকা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যে সীমান্তের ওপারে রাখাইন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই চললেও এবার বেকায়দায় আছে দেশটির সরকারি বাহিনী। জাতিগত নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা। তাদের বেশিরভাগই আছেন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে। ২০১৭ সালে রাখাইন প্রদেশে সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষের পর যে দমন অভিযান চলে, তাতে সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। প্রথমে বাংলাদেশ সীমান্ত আটকে রাখলেও পরে খুলে দিলে একবারেই চলে আসে ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমানে আছেন ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা অনেকের মোবাইল ফোনে অডিও, ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। এমন কিছু বার্তা এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। একটি ভিডিওবার্তার বরাত দিয়ে সূত্র জানিয়েছেন, মিয়ানমারে বিজিপির এক ফাঁড়িতে কিছু অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন যুবক। এর মধ্যে একজন নিজেকে আরএসও যোদ্ধা দাবি করে আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এখন আমাদের দখলে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা ভাই-বোনরা দেশে ফিরে আসেন। এখানে এসে নিজ নিজ গ্রামে ঘর করে বসবাস করেন।” কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক ব্লকের কমিউনিটি নেতা আবদুল গফুর জানিয়েছেন, এমন অডিও-ভিডিও বার্তা অসংখ্য রোহিঙ্গার মোবাইলে এসেছে। যেখানে আরকান আর্মির পক্ষেও রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আরকান আর্মির পক্ষে রোহিঙ্গাদের স্ব-স্ব গ্রাম-ঘর তৈরিতে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। রফিকুল ইসলাম নামের বালুখালী ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা জানান, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকে ইতোমধ্যে মিয়ানমার ফেরত যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবরই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার এজন্য চুক্তিবদ্ধ হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি এতদিনেও। রোহিঙ্গারাও নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকে নিজ দেশে ফেরায় অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছিল। মিয়ানমার জান্তা সরকারের পক্ষে প্রত্যাবাসন নিয়ে যা করা হচ্ছে তা ‘নাটক’ বলে মনে করছেন বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আজমত উল্লাহ।
তিনি জানান, রাখাইন রাজ্য জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। বিজিপি, সেনা সদস্যও প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে আসছে। আরকান আর্মি সব সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির অবস্থানে বিশ্বাসী হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। রোহিঙ্গারাও ‘পজিটিভ’ চিন্তা করতে শুরু করেছেন। বিশাল শরণার্থীর ভার দীর্ঘদিন বহন করে আসা বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের এখন বোঝা হিসেবে দেখছে। নিরাপত্তার জন্য তারা হুমকি হয়ে উঠছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য। সেই সময়ে বিদ্রোহীদের এ আহ্বানকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত যাওয়ার ‘চূড়ান্ত সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন কক্সবাজারের সামাজিক সংগঠন পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের উচিত মিয়ানমারের যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সেখানে ফেরত যাওয়া। এটা রোহিঙ্গাদের জন্য মঙ্গল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের কাছে বিভিন্ন বার্তায় ফেরত যাওয়ার আহ্বান জানানোর বিষয়টি নানাভাবে শোনা যাচ্ছে। এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পক্ষে। এজন্য কাজও করছে সরকার।
উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা: নুরজাহান বেগম। বয়স ৪০-এর বেশি। কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের নয়া পাড়ায় তার বাড়ির আঙিনার পাশেই বৃহস্পতিবার দুপুরে মিয়ানমার থেকে উড়ে এসে একটি মর্টার শেল পড়ে। এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রশাসনের লোকজন ভারী গোলাটি নিষ্ক্রিয় করলেও ভয় কাটছে না নুরজাহানের মতো বহু পরিবারের। ভয়ে খেয়ে না খেয়ে পাহাড়ের ঢালুতে গিয়ে থাকছেন তার মতো একাধিক পরিবারের সদস্যরা। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ। সময় কাটছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
সরেজমিনে জানা গেছে, প্রায় বছর কয়েক ধরে সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেলসহ নানা ভারী অস্ত্রের আওয়াজে এপারের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু-বাইশপারী ও উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও তুমব্রুর পশ্চিম, উত্তর ও মধ্যমপাড়ায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় পরপর ১৫টি ভারী অস্ত্র নিক্ষেপের আওয়াজ শোনা যায়। তখন সেখানকার লোকজনের মধ্যেও চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। নুরজাহানের মতো তুমব্রুর পশ্চিম, উত্তর ও মধ্যমপাড়া, উখিয়ার রহমতের বিলের বহু পরিবার এখন দুঃশ্চিন্তায় আছে। আতঙ্ক বিরাজ করছে প্রতিটি ঘরেই।
পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশাচালক ছাদেক হোসেন বলেন, ‘রাতে ভারী গোলাবর্ষণের আওয়াজ কিছুটা কমে। কিন্তু সকাল থেকেই ভয়াবহতা শুরু হয়। একদিক থেকে একটা ফায়ার হলে অন্যদিক থেকেও তার জবাব দেয়। প্রতি ১০ মিনিট পরপর এমন শব্দ ভেসে আসে আমাদের গ্রামে।’ সীমান্ত পিলার ৩৩ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বসবাস করেন কৃষক নুরন্নবী।
তিনি জানান, দিনে অনেকটা চাষাবাদের কাজে থাকলেও রাতে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ঢালুতে চলে যান। বাড়ি থেকে দূরে হলেও সন্তানদের কথা বিবেচনা করে এমন সিদ্ধান্ত তার। উত্তরপাড়ার আরেক বাসিন্দা হামিদুল হক। কয়েকদিন আগে তার বাড়ির সামনের কাঁচা সড়কে এসে মর্টার শেল পড়ে। ফেটে যায় বসতবাড়ির দেয়াল। ভয়ে সেই থেকে বাড়িছাড়া হামিদুল।
চায়ের দোকানদার এলমা খাতুনের কণ্ঠেও ফুটে উঠেছে মিয়ানমার থেকে ভেসে আসা গোলার শব্দের ভয়াবহতা। তিনি বলেন, ‘সরকার এখনো আমাদের অন্য জায়গায় নেয়ার ব্যবস্থা করছে না। মনে হচ্ছে এখানেই মারা পড়ব। এ ছাড়া তো কিছু করার নেই।’
ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শহিদ উদ্দিন জানায়, কয়েকদিন থেকেই তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বাড়ি থেকে বের হলেই বকা দিচ্ছেন মা। গুলির শব্দ বেড়ে গেলে বিজিবি এসে দোকানপাট-ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। এ ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেই। কলেজশিক্ষার্থী সাদিয়াতুল জান্নাত বলেন, ‘পরিবারের লোকজন বাজার-হাটে যাচ্ছে। সব সময় তাই চিন্তায় থাকতে হয়, কেউ আঘাত পেল কি না।’
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক ধলে মর্টার শেল ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ এপারে শোনা যাচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তের দেড়-দুই কিলোমিটার দূরের পাহাড়ে গিয়ে পড়ছে এক একটা শেল ও গুলি। থেমে থেমে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে গোলাগুলি। শূন্যরেখার দিকে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের টানা যুদ্ধের পর ‘আপাত শান্ত’ হয়ে এসেছে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত। বৃহস্পতিবার দিনভর ঘুমধুম, তুমব্রু, পালংখালী, রহমতের বিল এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা এই আতঙ্কের কথা জানান।
এর ছাপও রয়েছে সীমান্ত এলাকায়। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল বেড়েছে, দোকানপাটও খোলা রয়েছে। কিন্তু যারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে কাছে-দূরের আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, ‘শান্ত’ পরিস্থিতিতে তারা ফিরতে ভয় পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। যদিও, বাড়ির গবাদি-পশু ও মালসামানা দেখভাল করার জন্য কেউ কেউ ঘরে ফিরছেন। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি না।
এদিকে বৃহস্পতিবার আর নতুন করে মিয়ানমার থেকে যুদ্ধ ছেড়ে কেউ পালিয়ে আসেনি। বরং তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পালিয়ে আসা যেসব বিজিপি সদস্যদের রাখা হয়েছিল তাদের টেকনাফের হ্নীলা উপকূল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই দেশের আলোচনার প্রেক্ষাপটে তাদেরকে কক্সবাজার থেকে গভীর সমুদ্রপথে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে গত রোববার থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর ৩৩০ জন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
এ পরিবারের এক নারী সদস্য বলেন, আতঙ্কের কারণে আমরা নিরাপদ জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। ঘর ফেলে এভাবে কয়দিন থাকব। যত আত্মীয়-স্বজন হোক। এখন এলাকার সবাই বলতেছে, দখল হওয়া ক্যাম্পগুলোতে সরকারি বাহিনী আবার হামলা করে কি-না। তখন আবার কোথাও না কোথাও পালাতে হবে। আমরা তো একেবারে সীমান্তের কয়েক গজের মধ্যেই আছি। বুধবারও ঘুমধুম বাজারে এক যুবক আলোচনার সময় দাবি করেছিলেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিপির রাইট ক্যাম্প এবং লেফট ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরেও রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যে কয়টি ক্যাম্প হাতছাড়া হওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে; তার মধ্যে এ দুটি রয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, যেহেতু দুটি ক্যাম্প থেকেই বিজিপি সরে গেছে ফলে সেখানে এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরাকান আর্মি।
৫৮ বছর বয়সি রশিদ আহম্মদ নামে একজন বাসিন্দা বলেন, ৩০ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করি। এরকম ঝামেলা কোনোদিন হয়নি। হলেও এত বড় আকারে হয়নি। ছোটখাট ঝামেলা হলেও কয়েক দিন পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এখন দেখি পরিস্থিতি অন্যরকম। সীমান্তের ওপারে কত দল, বাহিনীর কথা শুনি। সীমান্তে বিমান হামলার ভয়ের কথা সবাই বলাবলি করে। টানা কয়েক দিন ধরে গোলাগুলির পর পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে, মানুষ ঘর ছেড়ে বের হওয়া শুরু করেছে বলে জানান ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন সবার নতুন করে ভয় হচ্ছে, দখল হওয়া ক্যাম্পগুলো পুনর্দখল করার জন্য মিয়ানমার আবার কখন কী করে বসে। সাধারণ মানুষের ধারণা, গত কয়েকদিনে শত শত গুলি ছোড়া হয়েছে। এপারের লোকজনকে লক্ষ্য করেই তা ছোড়া হয়েছে।
এত গুলির মুখে উপস্থিত লোকজন দিকবিদিক ছুটতে থাকে। আবার অনেকেই জমিতে শুয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে সবাই নিরাপদ স্থানে চলে যায়। গোলাগুলির পর থেকে সীমান্তে আবারও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ