শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

আড়ালেই থাকছে হোতারা

প্রকাশনার সময়: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৫

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রতি ধরা পড়া শত কোটি টাকা মূল্যমানের প্রায় সাড়ে আট কেজি কোকেনের গন্তব্য ছিল পার্শ্ববর্তী একটি দেশে (ভারত)। এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৭ জনের মুখ থেকে এ ধরনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে বাংলাদেশে কারা তাদের আশ্রয়দাতা এবং কার ইন্ধনে এ ধরনের মাদকের চালান আনা হয়েছে সে বিষয়টি এখনো সামনে আসেনি।

এমন পরিস্থিতিতে এই চক্রে দেশি-বিদেশি মাফিয়া জড়িত রয়েছে বলে তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দাদের দাবি, গত ১১ বছরে অন্তত ১০টি চালানসহ বাহক গ্রেপ্তার হলেও আড়ালেই থেকে গেছে হোতারা। কাটআউট পদ্ধতিতে মাদক পাচার হওয়ায় জড়িতদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়।

জানা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি রাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়া শত কোটি টাকা মূল্যমানের প্রায় সাড়ে ৮ কেজি কোকেন পাচারের জন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। জব্দ হওয়া কোকেনগুলো দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপাদিত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বাংলাদেশে কোকেনের চালানটি ধরা না পড়লে স্থলপথে পাচারের টার্গেট ছিল।

বড় ধরনের এই মাদকের চালানের সঙ্গে কোনো কোনো দেশের মাদক মাফিয়ারা জড়িত তা জানার চেষ্টা চলছে। এমনকি বাংলাদেশি কোনো মাদক মাফিয়া কোকেনের জব্দ হওয়া চালানটির সঙ্গে জড়িত কিনা সেটি নিশ্চিত হতে রীতিমতো সম্মিলিত তদন্ত চলছে। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা একযোগে কাজ করছে জব্দ হওয়া কোকেনের আদ্যোপান্ত জানতে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহার অত্যন্ত কম। তবে বাংলাদেশি বেশ কিছু মাদক মাফিয়া আছে যারা কোকেনসহ নানা ধরনের মাদক চোরাচালানে জড়িত। বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের মধ্যে এককভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকার কোকেন কেনার অতীত রেকর্ড আছে। কিন্তু এককভাবে ১০০ কোটি টাকার কোকেন কেনার মতো মাদক মাফিয়ার সন্ধান মেলেনি। তবে অনেক মাদক মাফিয়া মিলে ১০০ কোটি টাকার কোকেন কিনেছিল তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কোকেনের এত বড় চালানের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কারণ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এ জন্যই জব্দ হওয়া কোকেন নিয়ে রীতিমতো শোরগোল চলছে। বিদেশি মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের জব্দ হওয়া কোকেনের বিষয়ে কোনো যোগসূত্র বা যোগাযোগ আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে, জব্দ হওয়া মাদকের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় মাদক বহনকারী মালাউয়ের নারী নোমথানডাজো তোয়েরা সোকোকে। মামলাটির তদন্ত করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ওবায়দুর রহমান। সার্বিক বিষয়টি তদারকি করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন।

এদিকে গত বুধবারই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানাধীন উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত হোটেল এনফোর্ড ইন থেকে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ মোহাম্মেদি আলি নামে তানজানিয়ার এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্র্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।

তদন্তকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সফলভাবে বিমানযোগে বাংলাদেশে আসেন তানজেনিয়ার ওই নাগরিক। এরপর তিনি হোটেলে উঠেন কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। প্রথমে ছোট চালানটি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হতে পারে। সেই চালানটি সফলভাবে পৌঁছার পরই হয়তো দ্বিতীয় চালানটি বিমানবন্দর থেকে খালাস করা হয়।

দুটি ঘটনার মধ্যে বিশেষ কোনো যোগসূত্রে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এত বড় একটি কোকেনের চালান বিমানবন্দর থেকে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই খালাস হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে বিমানবন্দরের কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্টদের কেউ জড়িত কিনা সে বিষয়ে গভীর তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোকেনের চালান ধরা পড়েছে। জব্দ হওয়া ওইসব কোকেন এসেছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জন্য। বাংলাদেশকে শুধু মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে। জব্দ হওয়া কোকেন কোন দেশে এবং কাদের কাছে পাঠানোর কথা ছিল তা জানতে গ্রেপ্তার নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে।

এছাড়া বাংলাদেশের কোনো মাদক মাফিয়া এর সঙ্গে জড়িত কিনা সেটিও জানতে সম্মিলিতভাবে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তার নারী মালাউইতে নার্স পেশায় জড়িত। এর আগেও তিনি ব্যবসায়িক পারপাসে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক তানভীর মমতাজ জানান, গত বছর তিনি গার্মেন্টস ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এবারও তিনি বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আসেন। অন অ্যারাইভাল ভিসা নেয়ার জন্য তিনি তার পরিচয় লুকিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন।

বাংলাদেশে অবস্থান করা একজন বিদেশির কাছে কোকেনগুলো হস্তান্তর করার কথা ছিল তার। এরপর ওই বিদেশির সঙ্গে চালানটি পার্শ্ববর্তী দেশের মূল গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল। চোরাচালান সম্পন্ন করে গ্রেপ্তার নারীর আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। চালানটির সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ জড়িত কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, গত বছরের ১০ জুন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় দুই কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হয় মরক্কো থেকে আসা ভারতীয় নারী সালোমি লালরামধারি। জব্দ কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারতের নয়াদিল্লি।

২০১৩ সালের ১১ জুন ঢাকার কারওয়ানবাজারের হোটেল লা ভিঞ্চি থেকে প্রায় তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হয় পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটা। মামলার আসামি এখনো কারাগারে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় আড়াই কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হন পেরুর আরেক নাগরিক জেইম বার্গলে গোমেজ। এ মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আসা সূর্যমুখী তেলের ড্রামে ভরা তরল কোকেন ধরা পড়ে।

জাহাজে একটি কনটেইনারে আসা ১০৭টি তেলের ড্রামের মধ্যে একটিতে কোকেন পাওয়া যায়। ড্রামটিতে প্রায় ১৮৫ কেজি সানফ্লাওয়ার তেলের পরিবর্তে ছিল তরল কোকেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ২৭০ কেজি হেরোইন ও পাঁচ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ বাংলাদেশি নাগরিক দেওয়ান রাফিউল ইসলাম হিরো ও জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে শ্রীলংকান পুলিশ।

এছাড়া ডিবি পুলিশ গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল থেকে বাত সোয়ানা নামে এক আফ্রিকান নারীকে প্রায় পাঁচ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করে। তিনি খেয়ে পেটের ভেতরে কোকেনগুলো নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে তার পেটা ব্যথা শুরু হলে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ডিবি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই আফ্রিকান নারী জানান তার পেটে কোকেন রয়েছে। যা তিনি খেয়ে এনেছেন। নির্ধারিত সময়ে একজন ব্যক্তির বিশেষ ট্যাবলেট নিয়ে তার কাছে আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে পেট ওয়াশ করে কোকেনগুলো বের করে। এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। এসব ঘটনায় বাহক ধরা পড়লেও এর পেছনের কারিগররা আড়ালেই থেকে গেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যত মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়, এর চেয়ে অনেক বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবনকারীদের হাতে পৌঁছে যায়। দেশে মাদকদ্রব্য আসা রোধে আকাশ ও নৌপথ এবং স্থল সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো জরুরি।

যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, কাট আউট পদ্ধতিতে মাদকের এই বড় চালানটি পাচার করা হচ্ছিল। এর আগেও এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এখানে হাত বদল হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ কাউকে চেনে না। দেশের বাইরে বসে এসব হাত বদলের প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাহক নির্দেশ মতো হাত বদল করে থাকেন। এক্ষেত্রে সাংকেতিক কোড অথবা ড্রেস কোড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার এ চক্রের হোতা নাইজেরিয়ার ডন ফ্রাঙ্কির ম্যানেজার বাংলাদেশের আসাদুজ্জামান আপেল, তার সহযোগী সাইফুল ইসলাম রনি, ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েঙ্গে এবং নাইজেরিয়ার ননসো ইজেমা পিটার ওরফে অস্কার ও নাডুলে এবুকে স্ট্যানলি ওরফে পোডস্কির কাছ থেকেও এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এরপর রোববার সংবাদ সম্মেলনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, যাত্রাবাহী ফ্লাইটগুলোতে যাত্রীদের মালপত্রের মধ্যে মাদক পাচার করে আসছিল এ চক্রটি। এ চক্রের হোতা ডন ফ্রাঙ্কির মূল নাম জ্যাকব ফ্রাঙ্কি। তিনি বিগ বস হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে নাইজেরিয়ান কমিউনিটির প্রেসিডেন্টও তিনি। গত ৯ বছর ধরে বাংলাদেশে থাকলেও ৯ মাস আগেই দেশ ছেড়েছেন। এখন নাইজেরিয়ায় বসেই বিভিন্ন দেশের মাদক বহনকারীদের সমন্বয় করছেন। তার হয়ে বাংলাদেশে কারা কাজ করছেন সে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ