বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ সমরে লড়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস প্রায় ৬৪ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৮ জন শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। সেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ৫২ বছরে প্রায় এক হাজার ৯৩০ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণ করেছে কয়েকশ জন। নিখোঁজ রয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। বিশ্বে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তগুলোর মধ্যে এখন বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত একটি।
সীমান্ত হত্যা দুই দেশের বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কে কোথায় যেন প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দেশ দুইটির উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি কোন কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। এবার দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা ছিটমহলের ভিতরে ভারতের আন্তঃজেলা মহাসড়কে গুলি করে হত্যা করা হয় রফিকুল ইসলাম (৩৩) নামের এক যুবককে। সীমান্ত হত্যা দিন দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এটা শুধু গাণিতিক সংখ্যা মাত্র। হোক সে নাগরিক কিংবা সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানীকে বিএসএফ গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। সেই মরদেহ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে রাখা হয়। সেই ছবি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু সীমান্তে বিএসএফরকে নাড়া দিতে পারেনি। সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান তাই বলে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ১৯৭২ সাল হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১৯৭২ সালে নিহত ১৫ জন, ১৯৭৩ সালে নিহত ২০ জন, ১৯৭৪ সালে নিহত ২৩ জন, ১৯৭৫ সালে নিহত ১১ জন, ১৯৭৬ সালে নিহত ১৬ জন, ১৯৭৭ সালে নিহত ২৭ জন, ১৯৭৮ সালে নিহত ১২ জন, ১৯৭৯ সালে নিহত ২২ জন, ১৯৮০ সালে নিহত ১৮ জন, ১৯৮১ সালে নিহত ১২ জন, ১৯৮২ সালে নিহত ১৯ জন, ১৯৮৩ সালে নিহত ১৬ জন, ১৯৮৪ সালে নিহত ২৩ জন, ১৯৮৫ সালে নিহত ২৭ জন, ১৯৮৬ সালে নিহত ৩০ জন, ১৯৮৭ সালে নিহত ১৭ জন, ১৯৮৮ সালে নিহত ১৩ জন, ১৯৮৯ সালে নিহত ১৭ জন, ১৯৯০ সালে নিহত ১৮ জন, ১৯৯১ সালে নিহত ১৫ জন, ১৯৯২ সালে নিহত ১৬ জন, ১৯৯৩ সালে নিহত ২৩ জন, ১৯৯৪ সালে নিহত ৩৯ জন, ১৯৯৫ সালে নিহত ৩৬ জন।
১৯৯৬ সালে নিহত ৩১ জন, ১৯৯৭ সালে নিহত ৩৩ জন, ১৯৯৮ সালে নিহত ৩৭ জন, ১৯৯৯ সালে নিহত ৩৮ জন, ২০০০ সালে নিহত ৩১ জন, আহত ১৭ জন, অপহৃত ১০৬ জন, ছিনতাই ২ জন, পুশইন ১৩ জন, ২০০১ সালে নিহত ৮৪ জন, আহত ২৯ জন, অপহৃত ৫৫ জন, ছিনতাই ১ জন, পুশইন ১০ জন, ২০০২ সালে নিহত ৯৪ জন, আহত ৪২ জন, অপহৃত ১১৮ জন, নিখোঁজ ৩০ জন, পুশইন ১২জন, ২০০৩ সালে নিহত ২৭ জন, আহত ৪১ জন, অপহৃত ১২০ জন, নিখোঁজ ৭ জন, ছিনতাই ২ জন, পুশইন ৮ জন, ২০০৪ সালে নিহত ৭২ জন, আহত ৩০ জন, অপহৃত ৭৩ জন, পুশইন ৫ জন, ২০০৫ সালে নিহত ৮৮ জন, আহত ৫৩ জন, অপহৃত ৭৮ জন, নিখোঁজ ১৪ জন, ছিনতাই ৩ জন, পুশইন ৪ জন, ২০০৬ সালে নিহত ১৫৫ জন, আহত ১২১ জন, অপহৃত ১৬০ জন, নিখোঁজ ৩২ জন, ছিনতাই ২ জন, পুশইন ৯ জন, ২০০৭ সালে নিহত ১১৮ জন, আহত ৮২ জন, অপহৃত ৯২ জন, নিখোঁজ ৯ জন, ছিনতাই ৩ জন, পুশইন ৫ জন, ২০০৮ সালে নিহত ৬১ জন, আহত ৪৬ জন, অপহৃত ৮১ জন, নিখোঁজ ৩ জন, পুশইন ২০ জন, ২০০৯ সালে নিহত ৯৮ জন, আহত ৭৭ জন, অপহৃত ২৫ জন, নিখোঁজ ১৩ জন, ছিনতাই ১, পুশইন ৯০ জন অন্যান্য অপরাধ ৩টি, ২০১০ সালে নিহত ৭৪ জন, আহত ৭২ জন, অপহৃত ৪৩ জন, নিখোঁজ ২ জন, পুশইন ৫ জন, ২০১১ সালে নিহত ৩১ জন, আহত ৬২ জন, অপহৃত ২৩ জন, পুশইন ৯ জন, ২০১২ সালে নিহত ৩৮ জন, আহত ১০০ জন, অপহৃত ৭৪ জন, নিখোঁজ ১ জন, পুশইন ৯ জন, অন্যান্য অপরাধ ১৬টি।
২০১৩ সালে নিহত ২৯ জন, আহত ৭৯ জন, অপহৃত ১২৭ জন, ছিনতাই ১ জন, পুশইন ৭৭ জন, অন্যান্য অপরাধ ৪১টি, ২০১৪ সালে নিহত ৩৫ জন, আহত ৬৮ জন, অপহৃত ৯৯ জন, নিখোঁজ ২ জন, অন্যান্য অপরাধ ৫টি, ২০১৫ সালে নিহত ৪৪ জন, আহত ৬০ জন, অপহৃত ২৭ জন, নিখোঁজ ১ জন। ২০১৬ সালে নিহত ২৯ জন, আহত ৩৬ জন, অপহৃত ২২ জন, অন্যান্য অপরাধ ৮৭টি, ২০১৭ সালে নিহত ২৫ জন, আহত ৩৯ জন, অপহৃত ২৮ জন, ২০১৮ সালে হত্যা ১১ জন, আহত ২৪ জন, অপহৃত ১৬ জন, ২০১৯ সালে হত্যা ৪১ জন, আহত ৪০ জন, অপহৃত ৩৪ জন, ২০২০ সালে নিহত ৫২ জন, আহত ২৭ জন, অপহৃত ৭জন, অন্যান্য অপরাধ ১টি, ২০২১ সালে হত্যা ১৭ জন, ২০২২ সালে হত্যা ২৩ জন এবং ২০২৩ সালে হত্যা ৩০ জন। আর সর্বশেষ চলতি বছরে প্রথম সীমান্ত হত্যার শিকার হলেন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীরই একজন সদস্য।
এমনকি বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাসে চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট ও সিলেট সীমান্তে ৮ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। বিএসএফ বিনা উষ্কানিতে এক হাজার ৯৩০ জন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটলেও একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। এই বিচারহীনতা সীমান্ত হত্যাকে বরং উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। কয়েক শত নদী পথেও সীমান্ত রয়েছে।
লালমনিরহাট জেলায় স্থল সীমান্ত রয়েছে প্রায় ২৭৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, বুড়িতিস্তা, মাদলাহ ও সানিয়াজান নদী সীমান্ত রয়েছে। দুই দেশের সাথে সীমান্ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজ করছে। এমনকি দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একসাথে যৌথটহল পর্যন্ত দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় নানা অকশনে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে মিষ্টি, ইলিশ মাছ, পাঠা ছাগল পর্যন্ত শুভেচ্ছা বিনিময় পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ ধরনের সম্পর্কের মধ্যে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড কোথায় যেন, বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমনকি সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১৮ সালে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পর্যায় সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি পর্যন্ত দিয়ে ছিলেন। এরপরও থামেনি সীমান্ত হত্যা। বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনাটা কথার কথা থেকে গেছে।
লালমনিরহাট সীমান্ত গ্রামের অধিবাসীরা বলছেন, সীমান্ত এলাকায় প্রায় চোরাকারবারীরা সকলকে গোপনে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন কাউকে দেখা মাত্রই গুলি ছোঁড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। অনেক সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করে মরদেহও নিয়ে যায় তারা। প্রতিটি সীমান্ত এলাকাতে রয়েছে কিছু দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সকল অপকর্ম। এই দালাল চক্রের ইশারাতেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটে। কারণ সীমান্তের নো ম্যান্সল্যান্ডে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না। নিরপরাধ লোকদের লক্ষ্য করেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গুলি ছুঁড়ে থাকে। এমনকি অপহরণের ঘটনাও কখনো কখনো ঘটে থাকে। সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি বিজিবি সদস্যকে হত্যার ঘটনা ঘটুক কিংবা বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটুক তখন বিজিবি কোনো তথ্য কিংবা সহায়তা করতে চায় না। সাংবাদিক পরিচয় পেলে ফোন কেটে দেয়। সেদিন আর কোনো ফোন রিসিভ হয় না।
লালমনিরহাট জেলার মোগলহাট ইনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ভারতের সদিচ্ছার অভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন কমছে না। মোগলহাট সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন দেখেছি বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনীর হাতে কিন্তু কখনো ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কিংবা সাধারণ ভারতীয়রা নির্যাতিত হয় না। এমনকি হত্যার শিকার হয় না। বরং ভারতীয় বিএসএফ এর দ্বারাই বাঙালিরা হত্যার শিকার হয়, নির্যাতিত হয়। বন্ধুপ্রতিম দুইটির রাষ্ট্রের সীমান্তে এমন হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া খুবে কষ্টের। এখানে বন্ধুত্বকে প্রশ্ন বিদ্ধ করতে পারে। সীমান্তে দেখেছি ভারতের দুর্গম গ্রামের মানুষ বাংলাদেশের হাটবাজারে এসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কিনে নিরাপদে বাড়ি চলে যাচ্ছে। বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। মানবিক কারণে বিজিবি ও সাধারণ মানুষ দেখেও দেখে না। এটা কিন্তু বাংলাদেশের দুর্বলতা নয়, বরং সহানুভূতিশীলতা ও সহনশীলতা।
নয়া শতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ