দৈনন্দিন জীবনে দেশে প্রচলিত আইনের অনেক বিষয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত হতে হয়। বিভিন্ন কাজ সূচারুরূপে সম্পাদনের জন্য আইনের যথাযথ বিধিবিধান জানা সচেতন নাগরিক হিসেবে খুবই জরুরী। আইনগত কোন কাজ সম্পাদনের জন্য সঠিক নিয়ম জানা না থাকলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। সঠিক পদক্ষেপের অভাবে হতে পারে মূলবান সম্পদ বেহাত। আসুন জেনে নেই আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় Power of Attorney বা আমমোক্তারনামা সম্পর্কে।
আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল কী: অনেক সময় ব্যস্ততা, বিদেশে অবস্থান, অসুস্থতা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে নিজের কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা অন্য ব্যক্তিকে (legal person) প্রদান করা জরুরী হয়। তখনই মূলত নির্দিষ্ট ক্ষমতা অর্পন করে Attorney বা আমমোক্তার নিয়োগ করা হয়।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইন, ২০১২ এর ধারা ২ এর উপধারা (১) অনুযায়ী পাওয়ার অব অ্যাটর্নি/আমমোক্তারনামা দলিল হলো এমন কোনো দলিল, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি তার পক্ষে উক্ত দলিলে বর্ণিত কার্য-সম্পাদনের জন্য আইনানুগভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট ক্ষমতা অর্পণ করেন। আইনত বৈধ এমন যে কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য যে কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতা প্রদান করা যায়। উক্ত আইনের ধারা ২ এর উপধারা (৩) মোতাবেক কোনো সমিতি, কোম্পানি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সমবায় সমিতিও উহাদের প্রয়োজনে আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদন করতে পারবে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অবশ্যই লিখিত হওয়া, যে কার্য সম্পাদনের জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে তা সুনির্দিষ্ট হওয়া এবং পাওয়ার দাতা ও গ্রহীতার এক কপি ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্ত থাকা বাঞ্চনীয়।
আমমোক্তারনামা/পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলের প্রকারভেদ-
১. অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি: উক্ত আইনের ধারা ২ এর উপধারা (৪) অনুযায়ী যে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়, বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন বা ঋণ গ্রহণের বিপরীতে স্থাবর সম্পত্তির বন্ধক প্রদান অথবা স্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে পণ মূল্য গ্রহণের বিনিময়ে ভূমি উন্নয়নসহ উক্ত দলিল সম্পাদনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়, সেটিই অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি। অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি রেজিষ্ট্রেশন এ্যাক্ট ১৯০৮ এর বিধান সাপেক্ষে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। উক্ত দলিলে অবশ্যই পাওয়ারদাতার উদ্দেশ্য এবং পাওয়ারগ্রহীতার দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কার্যাবলীর সুস্পষ্ট বিবরণ থাকতে হবে।পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দাতা বিদেশে অবস্থান করলে বা প্রবাসী হলে:
যদি কোনো পাওয়ার দাতা বিদেশে থাকাবস্থায় পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে চান, তবে তিনি সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস/হাইকমিশন/পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অফিসের মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলটি সঠিকভাবে লিখে এবং পাওয়ার গ্রহীতার ছবি শনাক্ত করে উক্ত অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রমাণীকরণ (Authentication) অন্তেঃ উহা Stamp Act, ১৮৯৯ এর ১৮ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা কর্তৃক প্রয়োজনীয়রূপে স্ট্যাম্পযুক্ত করতে হবে এবং পরবর্তীতে উক্ত দলিলের একটি কপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কর্তৃক সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠাতে হবে। এবং উক্তরূপে কোনো কপি পাঠানো হলে, সেটা রেজিস্ট্রেশন আইন মোতাবেক সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার ১নং বহিতে নথিভুক্ত করবেন। পক্ষগণ সম্মত হলে রেজিস্ট্রার্ড চুক্তির মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মেয়াদ বাড়াতে পারবেন।রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কোনো সম্পত্তি সংক্রান্তে অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন বা বাতিলের ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজউকের পূর্বানুমতি নিতে হবে।
২. সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি: উক্ত আইনের ধারা ২ এর উপধারা (৭) মোতাবেক অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে সম্পাদিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নিই সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অবসান: পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইন, ২০১২ এর ১১ ধারায় পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অবসানের বিধান বর্ণিত হয়েছে যা নিম্নরূপ:
ক) নির্দিষ্ট কার্য-সম্পাদন বা বিশেষ উদ্দেশ্যে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদিত হলে উক্ত কার্য সম্পাদিত হবার পর।
খ) কোন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদিত হলে, উক্ত মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।
গ) কোন বিষয়বস্তুর উপর পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করা হলে সেই বিষয়বস্তুর বিনাশ বা অস্তিত্বের বিলোপ ঘটলে।
ঘ) অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ব্যতিত অন্যান্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ক্ষেত্রে পাওয়ারদাতা দেউলিয়া বা অপ্রকৃতিস্থ হলে বা মৃত্যুবরণ করলে বা পাওয়ারদাতার আইনী স্বত্বা (legal entity) বিলুপ্ত হইলে।এছাড়া সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দাতা উক্ত পাওয়ারগ্রহীতাকে রেজিস্টার্ড ডাকের মাধ্যমে ৩০ (ত্রিশ) দিনের নোটিশ প্রদানপূর্বক, প্রদত্ত ক্ষমতার অবসান ঘটাতে পারবেন এবং পাওয়ার গ্রহীতা উক্তরূপ নোটিশের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে পারবেন।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যা কিছু করা যায় না: অধিকাংশ বিষয়ের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্পণ/কার্য সম্পাদন করা গেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি করা যায় না। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা, ২০১৫-এর বিধি ৪ অনুযায়ী উইল সম্পাদন বা দাতা কর্তৃক সম্পাদিত উইল নিবন্ধনের উদ্দেশ্যে, দত্তক গ্রহণের ক্ষমতাপত্র সম্পাদন, দান ও হেবা সম্পর্কিত ঘোষণা সম্পাদন, ট্রাস্ট দলিল সম্পাদন এবং সরকার কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা ঘোষিত অন্য প্রকার দলিল সম্পাদন।
সতর্কতা: সাধারনত বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেই আমমোক্তার বা অ্যাটর্নি নিয়োগ করা উচিৎ। কারণ পাওয়ারগ্রহীতা কর্তৃক সম্পাদিত বা কৃত বা তার ফলপ্রসূত কোনো বাধ্যবাধকতা এমনভাবে বলবৎ হবে, যেন স্বয়ং পাওয়ারদাতা উক্ত কার্য সম্পাদন করেছেন। অনেক সময় আমমোক্তার গ্রহীতা নিজের নামে কিংবা প্রতারণামূলকভাবে জায়গা-জমি হস্তান্তর বা বিক্রি করে দেন। তখন মূল মালিক বিপদে পড়েন।
অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে ভূমি উন্নয়নের ক্ষমতা প্রদান করার পর, ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে ভূমি মালিকের বিরোধ প্রায়ই দেখা যায়। সেক্ষেত্রে যে কোম্পানিকে ক্ষমতা প্রদান করা হবে, সে কোম্পানি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া প্রয়োজন। যেমন- কোম্পানির Memorandum, Articles of Association & Form-XII ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করা যায় না এবং ভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পাওয়ার গ্রহীতার অংশের বিক্রয়, বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন বা ঋণ গ্রহণের বিপরীতে বন্ধকী দলিল সম্পাদনের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হবে না এবং উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বহাল আছে মর্মে গণ্য হবে।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। মেইল- [email protected]
নয়া শতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ