করোনা সংক্রমণ ক্রমে নিম্নমুখ হলেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এ রোগে তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসা দিতে। শয্যা খালি না থাকায় নতুন রোগীদের ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না।
বর্তমানে তিন মাসের শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
এদিকে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগে হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন আরো ৩০৭ জন। নতুন ভর্তি রোগীদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা।
এদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৩ জন। ডেঙ্গুর এ হিসাব মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত। চলতি মাসের ১৫ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ৪ হাজার ৪৩৫ জন। চলতি মাসের ১৫ দিনেই মারা গেছেন ১১ জন। সেপ্টেম্বরে প্রতিদিন গড়ে হাসপাতালে ভর্তি ২৯৫ জনের বেশি।
বুধবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের তিন তলায় ডেঙ্গু ইউনিটে ভর্তি তিন মাস ১০ দিন বয়সী শিশু মুন তাহা। গত সাত দিন আগে তার জ্বর আসে। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিন দিন আগে ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় এনে তাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মুন তাহার বাবা আরিফুর জামান বলেন, কীভাবে যে মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো, বুঝতে পারছি না। এলাকার কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা নেই। মেয়ের অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ায় তাকে তিন দিন আগে এ হাসপাতালে এনে ভর্তি করেছি। এখন তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।
পাশের বেডে ভর্তি মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা থেকে আসা সাত মাসের শিশু ইয়া হায়দার। অবিরাম কান্না করে যাচ্ছে। মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও কাজ হচ্ছে না। গত ৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে শিশুটির গায়ে জ্বর আসে। এলাকার একটি ক্লিনিকে ডাক্তার পরামর্শে ওষুধ খাওয়ালেও লাভ হয়নি।
পরে ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরীক্ষা করার পর ১১ সেপ্টেম্বর রিপোর্টে শিশুটির ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ওইদিনই তাকে হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শিশুটির মা লিজা আক্তার বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে মেয়েটি অনেক অসুস্থ। গত ৬ সেপ্টেম্বর ওর পিঠে একটি মশার কামড়ে দাগ বসে যায়, পরদিন থেকেই জ¦র। কিছুক্ষণ পরপর ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর আসছে। এ কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্তের প্ল্যাটিনেট কমে যাওয়ায় তাকে রক্তও দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মিরপুর-১৪ নম্বরে পাঁচতলা ভবনের নিচ তলায় ভাড়া থাকে। বাড়ির ভেতরের অংশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও বাইরে ময়লা-আর্বজনা। সেখানেই মশা বিস্তার অনেক। চিকিৎসা চললেও মেয়েটা কিছু খেতে পারে না। দিনভর কান্না করে। মেয়ের চিকিৎসা করাতে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কবে তার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে আর কত টাকা প্রয়োজন হবে, তা এখনো তাদের জানা নেই।
একই অবস্থা মিরপুর-১ নম্বরের আরেক বাসিন্দা মৌসুমি বেগমের। গত ৪ সেপ্টেম্বর ১০ বছরের ছেলে মাহিনকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করেন। সাত দিন আইসিইউতে ছিলেন মাহিন। মৌসুমি বেগম বলেন, আমার ছেলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে তার পেটব্যথা, কাশি, হাঁটুব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বরসহ শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভর্তির পর এক সপ্তাহ তাকে আইসিইউতে রাখার পর বেডে দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, বাসার আশপাশে ময়লা ও জমাট পানি থাকায় সেখানে এডিস মশা জন্মায়। সেসব মশা বাড়ির মধ্যে এসে কামড়ায়। এভাবেই তার সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের পার্শ্ববর্তী বাসাগুলোর অনেক শিশুও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ২৯১ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এক হাজার ৯২ জন।
অন্যান্য বিভাগে চিকিৎসাধীন আছেন ১৯৯ জন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০৭ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ঢাকায় সরকারি হাসপাতালে ৮৮ জন ও বেসরকারি হাসপাতালে ১৫৬ জন। এ সময়ে বিভিন্ন বিভাগে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৬৩ জন। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৩১ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ জন। আর চলতি বছরে মারা গেছেন ৫৭ জন।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ হাসপাতালে মোট ৬৩০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরো পাঁচজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। গত সাত দিনে ৮৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গু ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন বেডে ৬২ জন ভর্তি রয়েছে। আইসিইউতে রয়েছে চারজন। এ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই মিরপুরের বাসিন্দা।
জানতে চাইলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, প্রতিদিন যে পরিমাণে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হতে আসছে কিন্তু সবাইকে ভর্তি করতে পারছি না। হাসপাতালের সব শয্যায় রোগী ভর্তি থাকায় নতুন রোগীর জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে আমাদের চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, এক দিকে করোনা তার ওপর ডেঙ্গু মহামারিতে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যার যার বাসার আশপাশ নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বৃষ্টি যতদিন থাকবে, ডেঙ্গুর প্রকোপও থাকবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ