শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

ভারত কেন বাংলাদেশের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশনার সময়: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪০

ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি প্রতিবেশী দেশ নয়। এই দেশ ভারতের একটি কৌশলগত অংশীদার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ৷ তাই, ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা যুক্তি দেন যে ঢাকায় দিল্লির একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার প্রয়োজন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন শেখ হাসিনা। এই সম্পর্ক ন্যায্য।

বাংলাদেশ যখন ৭ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে বেশ আলোচনা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলো বলে চলেছে যে, শেখ হাসিনা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন বলে তারা বিশ্বাস করে না। এসব দল তার পদত্যাগ এবং একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। এই দাবি সংবিধান সম্মত নয় বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

২০২২ সালে ভারত সফরের সময়, তিনি বলেছিলেন যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। তাই দেশটি, দেশটির সরকার, ভারতের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু তার সঙ্গে ভারতের এই সুসম্পর্কের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির সিনিয়র নেতা রুহুল কবির রিজভী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করা, কোনো বিশেষ দলকে নয়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় না, এমন অভিযোগও করেছেন তিনি। তার মতে, একটি ‘ডামি নির্বাচন’কে সমর্থন দিয়ে, শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করছে দিল্লি।

এমন সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারতের স্পষ্ট অবস্থান হলো, দেশটি মনে করে যে, নির্বাচন বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে সেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় ভারত।

তবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বিএনপি এবং জামায়াত-ই-ইসলামীর প্রত্যাবর্তন হলে বাংলাদেশে মৌলবাদের ফিরে আসার পথ প্রশস্ত করতে পারে বলে উদ্বেগ আছে ভারতের। এর কারণ হলো, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকার সময় এমনটিই হয়েছিল। তখন দল দুটো অনেক জিহাদি গ্রুপের জন্ম দিয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃতও হয়েছিল। এসবের মধ্যে ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মতো ঘটনা ছিল।

অন্যদিকে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ফলে তা দিল্লির পক্ষে যায়।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভাষাগত সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে মিত্রবাহিনীকে প্রেরণের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশকে ৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত।

ঢাকায় বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারের পক্ষ নিতে ভারতের কাছে অন্যান্য কৌশলগত কারণও রয়েছে। দেশটি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তার উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে সড়ক ও নদীপথে পরিবহনের সুবিধা চায়। তবে বাংলাদেশে ভারতের একটি ভাবমূর্তিগত সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ তার এই ভালো প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে সবসময় যেটা পাওয়ার সেটা সর্বোচ্চটা পায় না, দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে ন্যায়সংগত বাটোয়ারা হয় না ইত্যাদি অভিযোগ প্রচলিত আছে।

ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সড়ক, নদী এবং রেলওয়ের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ভারত বিরোধী সমালোচকরা যে বিষয়টি সামনে এনে থাকেন, তা হলো, ভারতের ভূমি ব্যবহার করে ল্যান্ডলকড কান্ট্রি নেপাল এবং ভুটানের সাথে সম্পূর্ণ ওভারল্যান্ড বাণিজ্য করতে বাংলাদেশ এখনো পারছে না।

এখন ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বে সড়ক ও ট্রেনের সংযোগ একটি ২০ কিলোমিটার ল্যান্ড করিডোর, যার উত্তরে নেপাল ও ভুটান, এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ৷ দিল্লির কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে, ভারতের এই অংশটি ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীনের সাথে সম্ভাব্য সংঘর্ষের ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধুয়া তুলে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চেয়েছিল। এমন পদক্ষেপকে ‘প্রতিকূল’ বলে অভিহিত করে ভারত তার বিরোধিতা করছে।

ভারত যখন বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন, সেখানে বাংলাদেশের অনেকেই ভারতের ভূখণ্ডে কী ঘটছে তা নিয়ে চিন্তিত৷ ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলো বলে থাকে যে, ভারতে ২০১৪ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বেড়েছে। বিজেপি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও তাদের দেশে ‘বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের কথিত অনুপ্রবেশের অভিযোগ তোলেন। এমন অভিযোগকে শক্ত ভিত্তি দিতে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের দিকে আঙুল তোলা হয়। ভারতীয় মুসলমানদের নিপীড়ন করা হলে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৮% হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের প্রচণ্ড আশঙ্কা দেখা দেয়। শেখ হাসিনা ভারতের শত্রু নন, এটা ভারত বোঝে। কিন্তু ভারত যে বাংলাদেশের বন্ধু, এটি বাংলাদেশিদেরকে বোঝানোই চ্যালেঞ্জ। সূত্র-বিবিসি

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ