ময়নাতদন্তের ফাঁদে আটকা পড়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপির) ৫০টি থানার ৩২৫৪ মামলার তদন্ত। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ডিএমপির এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এমন তথ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে ৪৬৬টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৭১টি, মার্চে ৫০৪টি, এপ্রিলে ৫২৮টি, মে মাসে ৪৭৫টি, জুন মাসে ৪১৩টি ও জুলাই মাসে ৩৯৭টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীর পরিবার। তবে প্রথম কয়েক মাসের কিছু প্রতিবেদন পাওয়া গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, আরো কিছু সরকারি হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি বর্তমান ডেডিকেটেড হাসপাতালে পর্যাপ্ত লোকবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ালে এ ধরনের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। এতে ময়নাতদন্ত নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কমে আসার পাশাপাশি অনৈতিক লেনদেনের বিষয়টিও কমে আসবে।
জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মো. ফারুক হোসেন বলেন, প্রথম সাত মাসের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেখানে এক মাসের অধিক সময় পর্যন্ত আটকে থাকা ময়নাতদন্ত বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গত কয়েকমাসে আরো কিছু তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী মামলার তদন্ত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। অনেক সময় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর মামলার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ কারণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার তদন্তে একটা বড় পার্ট।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন কোন থানা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হবে সেটা জানতে চেয়ে ডিএমপিকে একটি চিঠি দিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেই চিঠির পর থানাগুলোকে নিকটস্থ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও আগে থেকে হাসপাতাল ভাগ করে দেয়া রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবিকা রায় বলেন, লোকবল সংকট ও লাশের চাপ বেশি থাকার কারণে প্রতিবেদন দিতে সময়ক্ষেপণ হয়। এতে অনেক সময় নির্ভুল ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয় না। আবার এ টাকা পুঁজি করে অনেক অনৈতিকারও সুযোগ থাকে। এ কারণে লাশের চাপ কমাতে কলেজের পক্ষ থেকে থানার বিন্যাস চেয়ে ডিএমপি কমিশনারকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠির জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ঢামেকে বছরে গড়ে ৩ হাজার লাশের ময়নাতদন্ত করতে হয়। অথচ একই সময় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এক হাজার এবং মিটফোর্ড ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৬শ’ লাশের ময়নাতদন্ত করছে। এ কারণে ডিএমসিতে ময়নাতদন্ত জটের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পুলিশ কমিশনার বরাবরে পাঠায়। এতে বলা হয়, অনেক বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড) ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগ ঢাকা জেলার ময়নাতদন্ত ও মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করে আসছে। ২০১৮ সাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগ নতুন করে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এছাড়া আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ময়নাতদন্ত ও মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার জন্য মৃত দেহ ও ভিকটিম ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগে আসে। তাই এই পরীক্ষা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগকে করতে হয়। এ অবস্থায় ঢাকা মেট্রোপলিটনের থানাগুলোর ময়নাতদন্ত ও মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তা এই তিনটি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগে জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এলাকাভিত্তিক সম বণ্টন করে দিলে কাজের চাপের সমতা আসবে। এতে দ্রুত গতিতে রিপোর্ট দেয়া সম্ভব হবে। ওই চিঠির পর ডিএমপির পক্ষ থেকে চলতি বছরের শুরু থেকে এক মাসের অধিক সময় ধরে ময়নাতদন্তের কারণে আটকে থাকা মামলার সংখ্যার তালিকা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে ৩ হাজার ২৫৪টি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আটকে আছে। তবে এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক মামলার তদন্ত ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। অথচ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, অপমৃত্যু মামলার ক্ষেত্রে মাসের পর মাস ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয় না। ফলে লাশ কাটা ঘরের ‘অন্ধকার টেবিলে’ আটকে থাকে এসব মামলার তদন্ত ও ভবিষ্যৎ।
ডিএমপির সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে ৪৬৬টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৭১টি, মার্চে ৫০৪টি, এপ্রিলে ৫২৮টি, মে মাসে ৪৭৫টি, জুন মাসে ৪১৩টি ও জুলাই মাসে ৩৯৭টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ক্লাস পরীক্ষা নেয়া ও একাডেমিক কাজের বাইরে সশরীরে উপস্থিত থেকে ময়নাতদন্ত করতে হয়। এরপর তার প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়; বিভিন্ন মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে হয়। এতকিছুর পর সময়মতো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনবল সংকট রয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে সিআইডির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে এবং মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে নমুনা পাঠানো হয়। এগুলো আসতে দেরি হয়। ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এসব কারণেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত মৃত্যুর কারণ সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এটি বিচার কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এই প্রতিবেদন ন্যায়বিচার অনেকাংশে নিশ্চিত করে। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পেলে মামলার তদন্তই থেমে থাকে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকা-ের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে দেরি হলেও নানা আলামতে তদন্ত চালিয়ে নেয়া যায়। অবশ্য সময়মতো না পেলে চার্জশিট দিতে দেরি হয়। এতে মামলাজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু অপমৃত্যু ঘটনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পেলে তদন্তই আটকে যায়। এ ধরনের মামলায় প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তদন্ত শুরু হয়। ময়নাতদন্তে অপমৃত্যু যদি হত্যাকা- প্রমাণিত হয়, তখন মামলার তদন্তের মোড় ঘুরে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত বা ভিসেরা প্রতিবেদন ছাড়া মামলার চার্জশিট বা তা নিষ্পত্তি করার সুযোগ নেই। দ্রুত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে হত্যা মামলার ক্ষেত্রে আসামি চিহ্নিত এবং ধরা সহজ হয়।
থানা পুলিশ সূত্র জানায়, শুধু হত্যাকা-ই নয়, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অপঘাতে মৃত্যুর পর পুলিশ এসব লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তের কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত লাশ মর্গের হিমাগারে রাখে। এ সময়ের মধ্যে কোনো স্বজন যদি মর্গে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে লাশ শনাক্ত করতে পারেন, তখন পুলিশের সহযোগিতায় লাশ তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। শনাক্ত না হলে নির্দিষ্ট সময় পর সেসব লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বিভিন্ন সরকারি কবরস্থানে দাফন করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি মর্গের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও যখন স্বজনদের কোনো খেঁাঁজ পাওয়া যায় না, তখন এসব লাশ আঞ্জুমানকে দিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। লাশ নিয়ে যদি আদালতের কোনো নির্দেশনা থাকে, কেবল সেসব লাশই সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মর্গের হিমাগারে রেখে দেয়া হয়।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সূত্র জানায়, অজ্ঞাত নারী-পুরুষের এসব লাশের নাম-পরিচয় আঞ্জুমানের কাছে নেই। বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গ ও থানা পুলিশের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি এসব লাশ গ্রহণ করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কেবল দাফন করে। পচা ও গলিত লাশগুলো গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্টরা আঞ্জুমানের হাতে কেবল পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টটি তুলে দেন। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জানান, সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। এ কারণে আরো কিছু সরকারি হাসপাতালকে ময়নাতদন্ত করার সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান হাসপাতালগুলোকেও পর্যাপ্ত লোকবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। এতে ময়নাতদন্ত জট অনেক কমে আসবে। একই সঙ্গে অনৈতিকতাও দূর হবে। মামলাগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে ময়নাতদন্তে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ কারণে দ্রুতই সবকিছু ঢেলে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে আমরা দিনকে দিন পিছিয়ে যাব।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ