যানজটের শহর রাজধানী ঢাকা। দিনদিন বেড়ে চলেছে যানজট। সঙ্গে গণপরিবহন ভোগান্তি। সড়কে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা। ঢাকার যানজট ও গণপরিবহনের নৈরাজ্য কমাতে সিদ্ধান্ত হয় চালু করা হবে রুটভিত্তিক বাস। বাস ভাড়াও ঠিক। দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে নানা সমীক্ষা। এই সময় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটির সভা হয়েছে ১৭টি। প্রতি সভায় বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে এখনো পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়নি। বারবার তারিখ পেছাচ্ছে। চলতি মাসের ৭ সেপ্টেম্বরও কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা ছিল। সেদিনও চালু করা সম্ভব হয়নি। বারবার মিটিং ও চালুর তারিখ দেয়া হচ্ছে। তাই প্রকল্প চালু না হওয়ায় অনেকের মনে প্রশ্ন, রুটভিত্তিক বাস চলবে তো রাজধানীতে!
জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরুর কথা ছিল রাজধানীতে। পরে পিছিয়ে সেপ্টেম্বরের ৭ ঠিক করা হয়। বর্তমানে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির শীর্ষ দায়িত্বে ঢাকার দুই সিটি মেয়র। সমীক্ষার প্রতিবেদনও সিটি করপোরশনের হাতে। ওই প্রতিবেদনে প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন ১০টি বাস টার্মিনালের। এসব টার্মিনাল নির্মাণ হলে দূরপাল্লার গণপরিবহনের কারণে সৃষ্ট যানজট থেকে মুক্তি পাবে রাজধানীবাসী। রাজধানীর ২৯১ রুট থেকে নামিয়ে আনা হবে ৪২টিতে। এখন চলছে ৩০ হাজার বাস। রুটভিত্তিক বাসের সংখ্যা কমিয়ে করা হবে ৯ হাজার ২৭টি। এসব রুটে ২৫শ’ বাস মালিকের সমন্বয়ে ৯টি ক্লাস্টারে ২২টি কোম্পানি চালাবে এসব বাস। মাদার কোম্পানি থাকবে ৬টি। এর মধ্যে সিটি সার্ভিসে ৬টি ও সিটি বাইবে থাকবে ৩টি কোম্পানি। ইতিমধ্যে রুটভিত্তিক বাসের ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। মহানগরীতে রুটগুলোতে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বর্তমানে ১ টাকা ৭০ পয়সা। তবে নতুন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত ৫০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। ফলে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া হবে ২ টাকা ২০ পয়সা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লকডাউন আর করোনার জন্য বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। প্রতিবার সভায় এ সার্ভিস পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা বিভিন্ন কারণে আটকে আছে। রাজধানীর প্রবেশমুখে থাকবে ১০টি টার্মিনাল। যার ফলে আন্তঃজেলা বাসগুলো রাজধানীতে ঢুকতে পারবে না। কর্মস্থলে পৌঁছাতে যানজটে বসে থাকতে হবে না। বেঁচে যাবে কয়েক ঘণ্টা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শহরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করছেন তারা।
জানা যায়, ডিএনসিসির তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক ২০১৫ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজধানীর যানজট কমাতে উদ্যোগ নেন। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মাঠে নামেন। একাধিক সভা করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের শুরুতে ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয় রঙের বাস নামানোর ঘোষণা দেন। তবে ২০১৭ সালে তার মৃত্যুতে এ উদ্যোগ থেমে যায়। পরে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো ও যানজট নিরসনে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্টের আদেশে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমদ খান ১০ সদস্যের একটি কমিটি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এরপর থেকেই শুধু মিটিং হচ্ছে। সভায় সিদ্ধান্ত হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মুখ থুবড়ে পড়া সেই উদ্যোগই নতুন করে এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়। এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত রুট দিয়ে চালু হওয়ার কথা ছিল রুটভিত্তিক এই পাইলট উদ্যোগের। আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেয়া হয় ‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পাইলটিং’। গত ২৪ জুন কমিটির ১৭তম সভা শেষে মেয়র তাপস বলেছিলেন, লকডাউনের কারণে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা বন্ধ থাকায় তারা ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস চালুর কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি। এপ্রিলেও চালু করা না গেলেও সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ থেকে এটি চালু হবে। সেটিও হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী এই প্রধান তিনটি টার্মিনালে বর্তমানে দেড় হাজার বাসের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। অথচ এসব স্থানে বাস রয়েছে প্রায় ১০ হাজারের অধিক। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের ওপর পার্কিং করে রাখা হয় কয়েক হাজার বাস। যার ফলে সরু হয়ে যাচ্ছে যানবাহন চলাচলের সড়ক। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে গাজীপুর, নবীনগর-চন্দ্রা রোডের বাইপাইল, কাঁচপুর উত্তর ও দক্ষিণ, কেরানীগঞ্জের বাঘৈর, সাভারের হেমায়েতপুর, বিরুলিয়া, কাঞ্চন, আটিবাজারের ভাওয়াল এবং ভুলতা এলাকায় টার্মিনাল করার প্রস্তাব করেছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এসব স্থানে টার্মিনাল নির্মাণ হলে আন্তঃজেলার বাসগুলো রাজধানীর মধ্যে ঢুকতে পারবে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গণপরিবহনগুলো টার্মিনালেই যাত্রীদের নামিয়ে দেবে। যাত্রীরা সেখানে থেকে রাজধানীতে প্রবেশ করবে নগরীর ভিতরে চলমান গাড়িতে করে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার পর গণপরিবহনের ওপর তেমন একটা নজর দেয়া হয়নি। তবে সরকার বর্তমানে আন্তরিক। আমরা রাজধানীর যানজট কমাতে ১০টি টার্মিনাল করার প্রস্তাব করেছি। সরকারি জায়গায় সেখানে এসব টার্মিনাল নির্মাণ হবে। এতে দূরপাল্লার কোনো বাস রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে না। যার ফলে ঢাকার যানজট কমে আসবে। তিনি আরো বলেন, রাজধানীর বাসগুলো ৬ কোম্পানির আওতায় ২২টি রুটে ভাগ করে চলবে। এতে নগরের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে, কমবে যানজট। তবে বাস্তবায়নের উদ্যোগে তেমন সাড়া নেই বাস মালিকদের।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) থেকে জানা গেছে, লকডাউন থাকায় এই পরিকল্পনার কাজ করা যায়নি। তাই এটি সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা হয়নি।
জানতে চাইলে পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে এই বিষয়টি বিলম্বিত হয়ে গেছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বৈঠকে বসব আমরা।
দুইবার সময় পরিবর্তন হলেও কবে আবার চালু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কমিটি থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। মিটিং ছাড়া এটি বলা সম্ভব নয়।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, লকডাউনের কারণে এই পরীক্ষামূলক চলাচল সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি আমার জানা নেই। আবারো এই বিষয়ে মিটিংয়ে বসব। তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ