ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘কোণঠাসা’ বিএনপি কৌশলী সরকার

প্রকাশনার সময়: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩১

সরকারের পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলন বিএনপি যাতে জোরদার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। ফলে সামনে বিএনপির জন্য আরও কঠিন সময় আসছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অপরদিকে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ড এবং সহিংতাকে কেন্দ্র করে বিএনপি হরতাল ও অবরোধের মাধ্যমে চূড়ান্ত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের কৌশলে পরিবর্তন আসবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

জানা গেছে, ২০১৩-১৪ ও ২০১৮ সালে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার অভিযোগে দায়ের করা সারা দেশের মামলার আসামিদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘সন্দেহভাজন সমস্যা সৃষ্টিকারীদের’ নতুন তালিকাও তৈরি করছে। তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের বেশিরভাগই বিএনপির নেতাকর্মী। পুলিশ সাধারণভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর নজর রাখছে এবং তাদের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা সব মেট্রোপলিটন কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাদের ‘সমস্যা সৃষ্টিকারীদের’ তালিকা তৈরি করতে বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।

সূত্র জানায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ বিভাগ ও গোয়েন্দা শাখা ‘সন্দেহভাজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের’ চিহ্নিত করছে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র‍্যাবকেও এ ধরনের তালিকা তৈরি ও নজরদারি জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপি সমর্থকরা কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্ত ও গৃহহীনদের অগ্নিসংযোগের জন্য অর্থ দিচ্ছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিএনপি সমর্থকদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সব ইউনিটকে ইউনিফর্ম ও সাদা পোশাকে টহল বাড়াতে বলা হয়েছে এবং ‘ঝামেলা সৃষ্টিকারীদের’ গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও একই নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে বিএনপি মনে করে, এসব উদ্যোগ সরকারের ‘মাঠ থেকে বিরোধী দলকে নির্মূল করার’ পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিএনপির আরও নেতাকর্মীকে কারাগারে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, ‘নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে তারা এসব করছে’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ নভেম্বর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, কেউ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাছাড়া নির্বাচনে বাধা দিতে পারে এমন বিএনপি কর্মীদের ‘মোকাবিলা’ করতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের জন্য দলের প্রত্যেক ইউনিটকে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আবার ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে ২০ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত থাকব। কিন্তু বিএনপিকে রাজপথে ছাড় দেব না। আমরা আমাদের প্রচারণা চালিয়ে যাব এবং একই সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করব।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির উত্তরা বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অগ্নিসংযোগের জন্য অর্থ দিয়েছে কিংবা এর সঙ্গে জড়িত, বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের এমন ৫০ জনকে চিহ্নিত করেছে তারা। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, নাশকতার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের আমরা চিহ্নিত করেছি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ৪০ সদস্যের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ, যার মাধ্যমে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা অগ্নিসংযোগকারীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।

এদিকে টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি না দিয়ে আন্দোলনের ধরনে পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি। আন্দোলনের কৌশলে পরিবর্তন আসবে বলে জানিয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের কৌশলে পরিবর্তন আসবে। সেটা সামনের সপ্তাহে আপনারা দেখতে পাবেন। অবরোধ-হরতালের পরিবর্তে নতুন ধরনের কর্মসূচি আসবে। সেটা অসহযোগ কিনা, এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে নীতিনির্ধারকরা নতুন ধরনের কর্মসূচি ঠিক করবেন।’

ব্যারিস্টার খোকন বলেন, ‘সরকার আন্দোলনে দমাতে পুলিশ, আদালত সবই ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। যুদ্ধ বলেন, আন্দোলন বলেন এর কৌশলই হলো আত্মরক্ষা এবং আক্রমণ। আমরা সেটাই করছি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে আছে বিএনপি ও তার শরিকরা। তবে আন্দোলন কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করছেন বিএনপির কয়েকজন নেতা। তারা বলছেন, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি বহু ব্যবহারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে। অতীতে এর উদাহরণ আছে। তাই বিকল্প কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।

এদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বুধবারও জামিন দেননি আদালত। ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় যে মামলা হয়েছে সেই মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে ২০ নভেম্বর এ মামলায় জামিনের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও সেদির রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অনুপস্থিত থাকায় শুনানি হয়নি।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবকে যে মামলায় জামিন দেয়া হয়নি দেশে আাাইনের শাসন থাকলে তিনি জামিন পেতেন। কারণ বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনার এক-দেড় কিলোমিটার দূরে ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি অসুস্থ, তিনি একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী এবং বয়স্ক মানুষ। জামিন পাওয়ার সব গ্রাউন্ড তার আছে। তারপরও তাকে জামিন দেয়া হলো না। ২৮ অক্টোবরের পর তার বিরুদ্ধে পাঁচ-সাতটি মামলা দেয়া হয়েছে। এ থেকেই সরকারের মনোভাব বোঝা যায়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দেয়া হয়েছে।’

কায়সার কামাল বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাও এখন কারাগারে আছেন। নেতাকর্মীরা অব্যাহত গ্রেপ্তারের মুখে আছেন এবং এখন পুরোনো মামলায় দ্রুত সাজা দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় একই ধরনের কর্মসূচি হরতাল-অবরোধের আন্দোলন তারা কত দূর নিতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে এটা বিএনপির একার আন্দোলন নয়, দেশের মানুষের আন্দোলন। দেশের মানুষই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে আন্দোলন কর্মসূচিতে যাতে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকে আমরা সেদিকে নজর দেব।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল, নির্বাচনের তারিখ কোনো বৈধ নির্বাচন কমিশন দেয়নি। ফলে ওগুলো আমরা আমলে নিচ্ছি না। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার আগ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ডাকার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের পর অবরোধে ফিরছে বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপি সপ্তম দফায় অবরোধ ডাকল। প্রথম কর্মসূচিটি ছিল ৭২ ঘণ্টার। এরপর প্রতিটি কর্মসূচি দেয়া হয়েছে ৪৮ ঘণ্টার। এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর এখন পর্যন্ত হরতাল বা অবরোধের মধ্যেই আছে। তাদের সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হবে মঙ্গলবার ভোরে।

এদিকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন তারা গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলে চলাফেরা করছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অজ্ঞাত স্থান থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে দলের কর্মসূচি দিচ্ছেন। বিএনপি অভিযোগ করেছে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ এবং এর পরবর্তী সময়ে এখন পর্যন্ত দলের ১৪ হাজার ৬৭৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোট মামলা হয়েছে ৩৪৬টি। একজন সাংবাদিকসহ নিহত হয়েছেন ১৫ জন। আহত হয়েছেন চার হাজার ৩৩৮ জন। এ সময়ে দ্রুতগতিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের পুরোনো মামলায় সাজা দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, দেশব্যাপী অবরোধ ও হরতালে গত ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ২৭৫টি যানবাহন ভাঙচুর, ২৪টি স্থাপনা ভাঙচুর ও ১১টি অন্যান্যসহ মোট ৩১০টি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ২৯০টি যানবাহন, ১৭টি স্থাপনা ও ৬৯টি অন্যান্যসহ মোট ৩৭৬টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

গত ২ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলায় আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর, ৫ নভেম্বর পিরোজপুর এবং ৬ ও ১৫ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলায় আওয়ামী লীগের দুটি অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। গাজীপুরের শ্রীপুর থানার বরমী ইউনিয়নের ১৩২ নম্বর গিলাশ্বর মরহুম আ. জব্বার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিনের তৈরি স্কুলঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় ১৯ নভেম্বর। দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে বিদ্যালয়টির ৪টি বেঞ্চ ও একটি টিনের জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনায় কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্যসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। এদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও ঘটছে। মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনা বাড়ছে।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ