ভারত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে উঠেছে ৩০টি ক্ষুদ্র অস্ত্রের কারখানা। এসব কারাখানা থেকে তৈরি অস্ত্রগুলো অল্প দামে বাংলাদেশে আসছে অবৈধভাবে। এরপর তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। কারখানাগুলো পরিচালনা করে ভারতের একাধিক ব্যক্তি। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কারবারিদেরও যোগসাজশ রয়েছে। এসব কারবার চালাতে সীমান্তের ২০টি পয়েন্টকে বেছে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের সরকারে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে দায়িত্বশীল সূত্রমতে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারি পাশ কাটিয়ে অস্ত্রকারবারি চক্রের শতাধিক সদস্য সারাদেশে অস্ত্র কেনাবেচাও করছে। ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কাছেও অস্ত্র পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জঙ্গি, পেশাদার কিলার, ডাকাত ও বিভিন্ন ক্যাটাগরির অপরাধীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি দেশের বিভিন্নস্থানে গ্রেফতার হওয়া অস্ত্রকারবারিদের কাছ থেকে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
অস্ত্রকারবারিদের বিষয়ে কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, অস্ত্রকারবারিদের ধরতে পুলিশ-র্যাবসহ সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে। করোনার মহামারির সুযোগে কেউ কেউ আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচা করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশে কোনো অস্ত্র তৈরির কারখানা থাকলে তা গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। কোনো দেশ থেকে অস্ত্র যাতে না আসতে পারে সেই জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কাজ করছে। কোনো অস্ত্রকারবারিকে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সপ্তাহ দুয়েক আগে রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে আন্তঃদেশীয় অস্ত্রকারবারি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৮টি বিদেশি পিস্তল ও ১৬টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। এই চক্রের অন্যতম সদস্য ধৃত আকুল হোসেন যশোরের শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই যশোর সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র কারবার চালিয়ে আসছিলেন। এমনকি তার সঙ্গে ভারতের অস্ত্রকারবারিদের সুসম্পর্ক আছে। ভারতীয় কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানাও আছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছেন আকুল হোসেন। তিনি বেশ কয়েক প্রভাবশালী কারবারির নাম বলে দিয়েছেন। পুলিশ তাদের প্রোফাইল সংগ্রহ করছে। এমনকি কয়েকজনকে নজরদারির আওতায়ও আনা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর ভাসানটেকে এক ঠিকাদারকে গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎস অনুসন্ধানে নেমে অস্ত্রকারবারি চক্রের সন্ধান পায় গোয়েন্দা বিভাগ। ওই ঘটনায় ৫ কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেশকিছু তথ্য পায়। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, দেশের একাধিক সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা। ওইসব সীমান্তে কারখানাও আছে। ওইসব কারখানা পরিচালনা করেন ভারতের একাধিক কারবারি। তাছাড়া ওইসব কারবারির সঙ্গে বাংলাদেশের অস্ত্রকারবারিদের যোগসাজশ রয়েছে। ধৃত কারবারিদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে নতুন একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তা যাচাই-বাচাইয়ে কাজও সম্পন্ন হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে অন্তত ৩০টির মতো অস্ত্র তৈরির কারখানা আছে। ওইসব কারখানা নিয়ন্ত্রণ করেন ভারতীয়রা। তাদের সঙ্গে দেশীয় কারবারিদের যোগসাজশ রয়েছে। যাদের যোগসাজশ রয়েছে তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া অস্ত্রকারবারিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের তথ্যগুলো আমরা গভীরে গিয়ে যাচাই-বাছাই করছি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, গত ১ সেপ্টেম্বর দারুসসালাম এলাকা থেকে আন্তঃজেলা অস্ত্রকারবারির ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ডে তারা অস্ত্র কেনাবেচার নানা তথ্য দিয়েছে। তাদের সহযোগীদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।
জেলার কয়েক পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, অস্ত্রকারবারিদের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে তালিকাসহ একটি নির্দেশনা এসেছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশের সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করতে। এমনকি যেসব সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানা আছে সেগুলোর সঙ্গে কাদের যোগাযোগ আছে তাও পর্যবেক্ষণ করে আইনের আওতায় আনতে বলা হয়। নির্দেশনা পেয়ে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি।
ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, অস্ত্রকারবারির মূল হোতা আকুল জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে সহযোগীদের নিয়ে তিনি গত ছয় বছরে দুই শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছেন। এর সবই আনা হয়েছে সীমান্ত পথে ভারত থেকে। ২০১৯ সালে আকুল একবার ধরা পড়েছিল। কিন্তু তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, সোনা ছিনতাই, মারামারিসহ কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলাসংক্রান্ত আটটি মামলা রয়েছে। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক কারা, এখন পর্যন্ত তিনি কাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছেন সেই তথ্য আমরা পেয়েছি। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী এক শ্রেণির দরিদ্র লোকজনকে অবৈধ অস্ত্র বহন করতে ভাড়া করা হয়। অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে তারা সীমান্ত পার করে নির্দিষ্ট স্থানে অস্ত্র পৌঁছে দেয়। এসব অস্ত্র তৈরিতে সীমান্ত এলাকায় ছোট ছোট অস্ত্রের কারখানা গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর নজরদারি পাশ কাটিয়ে চক্রের শতাধিক সদস্য সারাদেশে অস্ত্র কেনাবেচা করছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, অস্ত্রের বড় চালানগুলো দেশে যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, শার্শা, দর্শনা, শাহজাদপুর, হিজলা, আন্দুলিয়া, মান্দারতলা, বেনাপোল সীমান্তের গোগা, কায়বা, শিকারপুর, দৌলতপুর, দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে। সীমান্ত এলাকার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কারবারিরা অপকর্ম করছেন। তিনি আরো বলেন, দেশে আসা বেশিরভাগ অস্ত্র তৈরি হয় পাশের দুই দেশে। বিশেষ করে ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের শহর মুঙ্গেরে তৈরি হয় অস্ত্র। মুঙ্গেরের চুরওয়া, মস্তকপুর, বরহদ, নয়াগাঁও, তৌফির দিয়ারা, শাদিপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। ওইসব এলাকা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাঘেঁষা।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন দামে অস্ত্র বিক্রি করছে সন্ত্রাসীরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবৈধ অস্ত্রগুলোর বেশিরভাগই আসছে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা দিয়ে। আবার সীমান্ত এলাকায় যেসব কারখানা আছে সেখানে উন্নত দেশ থেকে অস্ত্র তৈরির যন্ত্রাংশ এনে সেখানে তৈরি করছে। বাংলাদেশের অপরাধীরা তা সংগ্রহ করে বিক্রি করছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া অস্ত্রকারবারিরা জানিয়েছে, একে-৪৭ রাইফেল ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা, আমেরিকার তৈরি পিস্তল এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা, নাইন এমএম পিস্তল ম্যাগাজিনসহ দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা, থ্রি টু বোরের রিভলবার ২ লাখ টাকা, উগনি কোম্পানির রিভলবার আড়াই লাখ টাকা, মাউজার পিস্তল দুই লাখ টাকা, ইউএস তাউরাস পিস্তল দেড় লাখ টাকা, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল তিন লাখ টাকা, জার্মানির রুবি পিস্তল দুই লাখ টাকা, ইউএস রিভলবার দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, চায়নিজ রাইফেল দুই লাখ টাকা, পাইপগান ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, গুলি প্রতি রাউন্ড দুই’শ টাকা, দেশি অস্ত্রের মধ্যে টুটু বোরের পিস্তল ৩০ হাজার ও রিভলবার ৪৫ হাজার টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অস্ত্র ও মাদক পাচারকারীদের কাছে বাংলাদেশ ট্রানজিট রুট হিসেবে বেশ নির্ভরযোগ্য হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরেই। ২০০১ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এর মূল কারণ চিহ্নিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে। মাদক উৎপাদনকারী ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এবং ক্ষুদ্র অবৈধ অস্ত্র উৎপাদনকারী ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্টের’ মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের অবস্থান। একই মত লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক অন স্মল আর্মস’ এবং কলম্বোভিত্তিক ‘সাউথ এশিয়ান স্মল আর্মস নেটওয়ার্কের। পুলিশের গবেষণায় বলা হয়েছেÑ অপরাধীরা হালকা, গুলি করার সময় শব্দ ও ঝাঁকুনি কম এবং সহজেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এসব অস্ত্র বেশি ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক ক্যাডার ও অপরাধীদের পছন্দের তালিকায়ও আছে ছোট আকারের অস্ত্র। ৭ দশমিক ৬৫ ক্যালিবার, ৭ দশমিক ৬২ ক্যালিবার, ৬ দশমিক ৩৫ ক্যালিবারের পিস্তল পাওয়া যাচ্ছে। বহন ও ব্যবহারে নিরাপদ বলেই তারা ওইসব অস্ত্রে ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। তাছাড়া উগনি কোম্পানির রিভলবার, মাউজার পিস্তল, ইউএস তাউরাস পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল, ইউএস রিভলবার, আমেরিকার তৈরি নাইন এমএম পিস্তল ও মেঘনাম কোম্পানির থ্রি টু বোরের রিভলবার, স্প্যানিশ আস্ত্রার মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, চীন, ইসরায়েল, জার্মানি ও রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা, ভারত ও মিয়ানমার থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে আসছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ