বিমানবন্দর থেকে ফেরত এলো কানাডাগামী ৪২ বাংলাদেশি। এতে কানাডার টরেন্টোয় ‘বিয়ের দাওয়াত’ খাওয়া হলো না তাদের। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাসপোর্ট চেকিং ইউনিট তাদের ফেরত পাঠিয়েছেন।
গত ৬ নভেম্বর সিলেট থেকে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে তারা বিমানে উঠেছিলেন। ৭ নভেম্বর ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ট্রানজিট হয়ে তাদের টরেন্টোগামী বিমানের বিজি ৩০৫ ফ্লাইটে ওঠার কথা ছিল। তবে হোটেল বুকিংসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় বাধ সাধেন বিমান কর্মকর্তারা। অবশেষে তাদের রেখেই উড়াল দেয় বিমান।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, একই আমন্ত্রণপত্র ও জাল কাগজপত্র দিয়ে এরা সবাই কানাডার ভিসা পেয়েছিলেন। বিষয়টি তদন্ত করছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার একাধিক সূত্র জানায়, টরেন্টো ও সিলেটের একটি সিন্ডিকেট জাল কাগজপত্র তৈরি করে এদের ভিসা করায়। কানাডায় যেতে আগ্রহী সিলেটের প্রায় শতাধিক ব্যক্তি ও পরিবারের সঙ্গে চুক্তি করে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা এসব ব্যক্তির নামে টরেন্টোয় একটি কাল্পনিক বিয়ের দাওয়াতপত্র তৈরি করে। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জাল তৈরি করে আলাদাভাবে ভিসার জন্য আবেদন করে।
কাল্পনিক এই বিয়ের কনের পিতা আমন্ত্রণ করেন কয়েকজনকে, কনের মা আমন্ত্রণ করেন কয়েকজনকে, কনের ভাই ও মামা আমন্ত্রণ করেন কয়েকজনকে। এমনকি কনে নিজেও কয়েকজনকে বিয়ের আমন্ত্রণ জানান। অনেকটা আশ্বর্যজনকভাবে প্রায় সবাই ভিসা পেয়ে যান। অথচ টরেন্টোর একাধিক সূত্র জানায়, ইনভাইটেশন অনুযায়ী, এ রকম কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান নেই। ভুয়া বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়েছে। মূলত চুক্তিতে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এদের কানাডা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
সিলেটে একটি সূত্র জানায়, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এই সিন্ডিকেট ২৫ জনকে নিরাপদে কানাডা পাঠাতে সক্ষম হয়। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আরও প্রায় ৮ জন পৌঁছান কানাডায়। এরা সবাই এরইমধ্যে টরেন্টোয় রিফুউজি ক্লেইম করেছেন বলে জানা গেছে। ৬ নভেম্বর এই সিন্ডিকেট একসঙ্গে ৪২ জনকে কানাডা পাঠাতে সিলেটে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে।
ঢাকায় বিমানের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৬ নভেম্বর সোমবার রাতে বিমানের টরেন্টো ফ্লাইট ধরতে তারা ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিটে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাদের আচরণে বিমানের পাসপোর্ট চেকিং ইউনিট সদস্যদের সন্দেহ হয়। তারা দেখতে পান প্রায় সবার সাদা পাসপোর্টে কানাডার ভিসা লাগানো রয়েছে। এতে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। বিমান কর্মকর্তারা তাদের আমন্ত্রণপত্র ও হোটেল বুকিং দেখতে চান। এ সময় ৪২ জন যাত্রীই একই বিয়ের আমন্ত্রণপত্র দেখান। হোটেল বুকিং দেখতে চাইলে কয়েকটি বাড়ি ভাড়ার ডকুমেন্ট দেখানো হয়।
যাত্রীরা বলেন, তারা যেহেতু বিয়েতে যাচ্ছেন, এজন্য একসঙ্গে থাকতে বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। কোনো কোনো যাত্রী এ সময় এয়ারপোর্টে বসেই টরেন্টোতে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে হোটেল বুকিং করান। কানাডায় এক বিয়েতে বাংলাদেশ থেকে একসঙ্গে এত অতিথি! অবাক হয়ে যান বিমান কর্মকর্তারা।
এ সময় বিমান কর্মকর্তারা তাদের ভিসার সত্যতা যাচাই করতে সিঙ্গাপুর ও দিল্লিতে ই-মেইল পাঠান। যাত্রীদের জানানো হয়, কানাডা বর্ডার এজেন্সি নিশ্চিত করলেই তারা বিমানে উঠতে পারবেন। ফ্লাইট চলে গেলেও বিমান কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে সবাইকে হোটেলে রাখবে এবং ১১ নভেম্বরের ফ্লাইটে যাওয়া নিশ্চিত করবেন। কিন্তু পরদিন সকাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুর ও দিল্লি থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় বিমান কর্তৃপক্ষ পাসপোর্টে সিলেটের দেওয়া ইমিগ্রেশন সিল কেটে দিয়ে লাগেজসহ তাদের বিদায় করেন। এই ৪২ যাত্রীর লাগেজ অফলোড করতে ওইদিন টরেন্টো ফ্লাইট প্রায় আধাঘণ্টা বিলম্বে ঢাকা ছাড়ে।
বিমানের আরেকটি সূত্র জানায়, বিমানের ই-মেইল পাওয়ার পর কানাডা বর্ডার এজেন্সি এই যাত্রীদের নথি দিল্লিতে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে পর্যালোচনা করায়। সূত্রমতে, পর্যালোচনা রিপোর্ট দেখে কানাডা বর্ডার এজেন্সির কর্মকর্তারাই অবাক হয়ে যান। শুধু এই ৪২ জন নয়, একই বিয়ের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে প্রায় ৭৫ জনেরও বেশি লোকের ভিসা হয় এবং এরই মধ্যে প্রায় ৩৩ জন কানাডা পৌঁছে গেছেন। কানাডা বর্ডার এজেন্সি বিষয়টি বিমান কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে।
বিমান সূত্র জানায়, এসব যাত্রী টরেন্টো পৌঁছে ইমিগ্রেশনে আটকা পড়লে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ১৮০০ ডলার করে জরিমানা হতো বিমানের। আর এরা যেতে না পারায় বিমানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। বিমান কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার যাত্রীদের ওপর বর্তাতে চাচ্ছে। আর যাত্রীরা বলছে, আমাদের ভিসা বৈধ, যেতে দেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। সুতরাং টিকিটের দায় যাত্রীদের দেওয়ার সুযোগ নেই।
সিলেট থেকে এই ৪২ যাত্রী কীভাবে বোর্ডিং কার্ড পেয়েছে তা তদন্ত করতে গত বৃহস্পতিবার বিমানের অভ্যন্তরীণ তদন্ত টিম সিলেটে যায়। তারা ওই সময় বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত টিম ফেরত যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও যাত্রীরা তাদের ডাকে সাড়া দেননি।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ