হ্যালো, স্যার ১২ টাকার একটি কাজ আছে। কোথাকার। গোপীবাগের। আগের যেটা, সেটাও একই এলাকার ছিল না। হ্যাঁ... না স্যার, এটা পাশের এলাকা। যা হোক কবে যাবে। কাল রাইতে স্যার। ১২ মানে? ১২ লাখ। জি। রিয়াল?? হুম। ও না বাংলা টাকা। ধুর এক... কম টাকার বিষয়ে আর কোনোদিন ফোন দিবেন না। এত ছোট কাজ আমি করি না’। ‘১২ লাখ রিয়াল হলে ভেবে দেখতাম। তাহলে স্যার না করে দিই। ওকে।’
কথোপকথনটি ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার হওয়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাব-ইন্সপেক্টর আকসাদুজ্জামান ও পেশাদার ডাকাত আমির হোসেনের। এ ধরনের ৩টি অডিও রেকর্ড রয়েছে নয়া শতাব্দীর হাতে। সেখানে দেখা গেছে, তারা ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের আগে এভাবে নিজেদের মধ্যে পরিকল্পনা করে নেন। গত বছরের ১৯ অক্টোবর বিমানবন্দর এলাকায় এক প্রবাসীর টাকা লুটের আগের দিনও তারা পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন সকাল সাড়ে ৭টায় আকসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ৮ জনের একটি দল রোমান মিয়া নামের দুবাই প্রবাসীর সর্বস্ব লুটে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, সিআইডি থেকে বরখাস্ত হওয়া গ্রেফতারকৃত এসআই আকসাদুজ্জামানকে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তার অপকর্মের বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। চাকরি জীবনে তিনি কতগুলো অপরাধ কর্মকা- চালিয়েছেন সেই তথ্যও দিয়েছেন আকসাদুজ্জামান। ডিবির আরেক সাব ইন্সপেক্টর রাশেদ তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। বছর দেড়েক আগে এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কোটি টাকা লুটের ঘটনায় পুলিশ এসআই রাশেদকে গ্রেফতার করে।
আকসাদুজ্জামান ও সোর্সের ৩টি ভয়েস রেকর্ডে যা আছে:
তখন আকসাদুজ্জামান আমিরকে বলেন, কিসে যাবে? আবারো আমির বলেন, স্যার এটি কিন্তু রিয়াল না। সবগুলো বাংলা টাকা। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, তাহলে বাংলা টাকা ১২ লাখ। ধুর মিয়া এত কম টাকা। আমি আকসাদ কি এত কম অর্থের কাজ করে? তখন আমির বলেন, স্যার আপনি যদি কাজটি করেন। তখন আকসাদুজ্জামান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আবারো বলেন, আমি কি এত ছোট কাজ করি? ধুর এসব ছোটখাটো কাজ আমাকে জানাইবেনই না। তখন আমির বলেন, তাহলে না করে দেই স্যার। ‘বাংলা ১২ লাখ ২০ লাখ’ এসব টাকা হইলো। মিয়া.... কথা কন। আবারো বলছি এসব ছোটখাটো কাজের বিষয় নিয়ে আমার সাথে আর কথা বইলেন না। আমির তখন বলেন, ঠিক আছে স্যার আমি না কইরা দেই। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, ১২ লাখ রিয়াল হইলে হইতো। কাজ কইরা পুষাইতো। এই সময় আমির আবারো বলেন, স্যার ১২ লাখ তো অনেক টাকা। এই কথা শুনে আকসাদুজ্জামান আবারো রেগে গিয়ে বলেন ধুর মিয়া। ... কথা আর কইয়েন না। মোটা অঙ্কের দাইন ধরেন। আপনি যদি এই রকম বড় কাজ পান তাহলে কথা কইয়েন। আমার তো অনেক জায়গায় দিতে হয়। সেটা কি আপনি বুঝেন না? তখন আমির বলেন, জি স্যার জি স্যার। হেইয়া স্যার-আপনি তো বুঝেন না। আমি তো ওই কাজে একজনকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। হে আরো চাইছিল। পরে স্যার ৫০ হাজার টাকা মিলাইয়া দিছি না স্যার? এই কথা বলার পর আকসাদুজ্জামান বলেন, ... গালি দিয়ে বলেন, এসব ঝামেলার কাজে যামু না ভাই। ঝামেলা ভালো লাগে না। ধুত...। এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আর কথা বইলেন না আমার সাথে। মিয়া কথা-কাজে কোনো মিল নাই। তখন আমির হোসেন বলেন, ঠিক আছে স্যার বড় কাজ হইলে জানামু স্যার। আকসাদুজ্জামান বলেন, ঝইঝামেলা হলে কোনো কাজে যামু না। বড় হোক আর ছোট হোক। ভালো বা নির্ভেজাল কাজ হলে আমারে বইলেন। বুঝেছেন ভাই। আবারো বলছি-ঝইঝামেলার কোনো কাজে আমি যামু না ভাই। আমির বলেন, এইডা ঠিক আছে স্যার। আপনি যেটা বলবেন সেটা করমু স্যার। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, ঠিক আছে সাক্ষাতে কথা বলব।
এই দুইজনের দ্বিতীয় ভয়েস রেকর্ডে সোর্স আমির হোসেন ফোন করেন আকসাদুজ্জামানকে। বলেন স্যার। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, আমি তো সকালে ফোন দিয়েছিলাম আপনাকে। ফোন তো ধরলেন না। তখন আমির বলেন, স্যার সকালে মনে হয় আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্যার আমি তো বরিশালে। আগামীকাল চইল্লা আসুম স্যার। আকসাদুজ্জামান বলেন, তাই। তখন আমির বলেন, স্যার আপনি অনুমতি দিলে আমি রাতেই চইল্লা আসুম স্যার। ঠিক আছে আমি অন্য একটি নাম্বারে আপনাকে ফোন দিচ্ছি। ওই নাম্বারটি ধইরেন।
তৃতীয় ভয়েস রেকর্ডে আকসাদুজ্জামান আমির হোসেনকে ফোন করেন। আমির ফোন রিসিভ করে বলেন, আসসালামু আলাইকুম। স্যার বলেন, জি বলেন, স্যার ১২ টাকার আরেকটি কাজ পেয়েছি। করবেননি স্যার। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, কী কাজ? উত্তরে আমির বলেন, স্যার করবেন কাজটি। এটি রিয়াল স্যার। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, আপনি কই? আমির বলেন, স্যার আমি তো দেশেই আছি। বরিশালে। আকসাদুজ্জামান বলেন, মোবাইলে তো আলাপ করা যাবে না কিছুই। হু এইডা কবে যাবে? তখন আমির বলেন, স্যার বুধবার রাতে। আপনি যদি করেন তাহলে দ্রুত সময়ে চইল্লা আসমো স্যার। তখন আকসাদুজ্জামান বলেন, আপনার এই নাম্বারটি তো খোলা আছে তাই না? আমির বলেন-জি স্যার। আকসাদুজ্জামান বলেন- ঠিক আছে এই বিষয়ে আমি পরে কথা বলব।
ভয়েস রেকর্ডে শোনা যায়, মোটা অঙ্কের অর্থ ছাড়া কাজ করি না। বড় বড় মালের কাজ ধরবা। তাহলে আমারে জানাবা। বুঝছো। বাংলা টাকা না ধরে রিয়াল বা ডলার হলে সবচেয়ে ভালো। সাবধানে কাজ করতে হবে। এক সোর্সের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এসব কথা বলছিলেন প্রবাসীর অর্থ ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সিআইডির সাব ইন্সপেক্টর আকসাদুজ্জামান। সোর্সের সঙ্গে কথা বলার অডিও ফাঁস হয়ে গেছে। কীভাবে হুন্ডি ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের টাকা লুট করতে হবে সেই পরিকল্পনার তথ্য ফাঁস হয় ভয়েস রেকর্ডে। এই সংক্রান্ত তিনটি অডিও রেকর্ড রয়েছে নয়া শতাব্দীর কাছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্যও উদ্ঘাটন করা হয়েছে। চাকরি জীবনে তিনি একাধিক টাকা লুটের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। গতকাল আকসাদুজ্জামানকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরাইশী বলেন, ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে গ্রেফতার আকসাদুজ্জামানকে আদালতে পাঠানো হলে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আগামীকাল তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন সময় ডাকাতির বিষয় স্বীকার করেছেন।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ