ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্দোলনের ‘ছক’ বিএনপির

প্রকাশনার সময়: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৪৯

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি)’ গঠনের দাবি আদায়ে সরকারবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে যেতে চায় বিএনপি। নুরুল হুদার নেতৃত্বের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। শুরু থেকেই এই কমিশনের ওপর অনাস্থা ছিল বিএনপিসহ অনেক দলের। তাই ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ ও ‘নিরপেক্ষ নতুন কমিশন’ গঠনের দাবি আদায়ে সব বিরোধী দলকে এবার পাশে চান তারা। সেই লক্ষ্যে আন্দোলন, ঐক্য, নির্বাচনকালীন নেতৃত্ব, ভোটে যাওয়া-না যাওয়াসহ নানা পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। একই সঙ্গে দল গোছানোর সময় হাতে রেখে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের পরিকল্পনাও রয়েছে।

তাই তাড়াহুড়ো না করে কিছুটা সময় নিয়ে আন্দোলন শুরুর সম্ভাব্য একটা ইস্যুও ঠিক করেছে তারা। মাঠ গরমে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে ইস্যু করতে চায় তারা। নতুন কমিশন মনঃপূত না হলে মাঠে নামবে বিএনপি। সেখান থেকেই শুরু হবে আন্দোলন। এরপর ধাপে ধাপে বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবে। গত বুধবার নয়া শতাব্দীকে দলটির একাধিক শীর্ষ নেতাবৃন্দ এমন তথ্য জানিয়েছেন। তাদের ভাবনায় আছে, নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার হবে। তার অধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এমন নির্বাচন হলে দল ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন। তবে তারা জানেন, কাজটা বেশ কঠিন। এমন বাস্তবতায় বর্তমান সরকারের পতনের বিকল্প কিছু দেখছে না দলটি।

আবার শিগগিরই সরকার পতনের মতো বৃহত্তর কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার অবস্থাও তাদের নেই। এ জন্য আরো সময় নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে তারা। গণ-আন্দোলন কিংবা বৃহত্তর কোনো আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুতি কতটা, সেটা পরীক্ষার জন্য আগামী বছরের শুরুর দিকটা বেছে নিয়েছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ সরকার। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে তা আদায়ের পর আমরা একটি নিরপেক্ষ ইসি গঠনে ভূমিকা রাখব। সেক্ষেত্রে আমলা নয়, সাবেক একজন বিচারপতিকে সিইসি চাই আমরা। তবে এগুলো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।

সরকারের মনোভাব বোঝার পরই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে নতুন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে। কেমন লোকজন নিয়ে কমিশন করা দরকার, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া হবে। এরপর শুধু অপেক্ষা আর দল গোছানোর পালা। সরকারবিরোধী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করলেও একই ব্যক্তির নাম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুটি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপির এক অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বর্তমান কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন দূরের কথা বরং সরকারের আজ্ঞাবাহী হিসেবে কাজ করেছে।

বিগত দিনে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনের আগে দফায় দফায় সরকারি দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী আইন ভঙ্গ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করা হলেও কোনো সমাধান দিতে পারেননি। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিএনপি অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আমরা একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। সেই সরকারকে যেই নামেই ডাকা হোক না কেন। আমরা দলনিরপেক্ষ সরকার চাই। সরকারের প্রভাবমুক্ত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন চাই।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ বলেন, আমলা নয়, বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নিয়োগ দিলে ভালো হবে। বিগত দিনে সার্চ কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রপতি নাম প্রস্তাব করেছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ রাষ্ট্রপতি সরকারের বাইরে যেতে পারে না। তাই বিএনপির এবার প্রত্যাশা থাকবে সাবেক বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে সিইসি নিয়োগ দেয়া হোক।

জানা যায়, ২০২২-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি এ কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। বর্তমান কমিশনের ওপর বিএনপির আস্থাহীনতা শুরু থেকেই। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই কমিশনের অধীন নির্বাচন হলে, তা কোনোভাবেই ভালো কিছু হবে না। তবে এবার আগেভাগেই নিরপেক্ষ নির্বাচন ও কমিশন গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখতে চাইছে দলটি।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, নতুন কমিশনেও সরকারের প্রভাব বজায় থাকবে। সেটাও আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হবে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে সেটাকেই আন্দোলনের ইস্যু বানানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, পছন্দের কমিশন দিয়ে আগের কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির কোনো লাভ হবে না। কাজেই এই ইস্যুতেই আন্দোলনে নামবে বিএনপি।

বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে ন্যূনতম একটা জায়গায় তো সফল হয়েই আছে। তা হলো একটি সর্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মাঠপর্যায় থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচন। সম্প্রতি রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু-তারাও একই কথা বলছেন। পাশাপাশি গুম-খুন, অগণতান্ত্রিক আচরণ, আমলাতান্ত্রিক খবরদারিত্ব- এ বিষয়গুলো আলোচনার মধ্যে চলে আসবে। মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন দলসহ অন্য বাম দলগুলোও বলছে, বিএনপি রাস্তায় নামুক, তাদের সঙ্গে থাকব।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপিতে এখনো অফিসিয়ালি কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। এখনো অনেক সময় বাকি। এখন আমাদের মাঠের জোট করতে হবে, মাঠে আরো ভালো ইউনিটি তৈরি করতে হবে। ২০ দলীয় ঐক্যজোটসহ আরো যারা আছে তারা এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে থাকতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আন্দোলন করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকার দলের সমর্থিত কমিটি আমরা মেনে নিব না। মুক্তচিন্তার মানুষ এখনো বাংলাদেশে আছে, তাদের নিয়ে কমিটি করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। সরকারের তৈরি ইলেকশন কমিশনের অধীন নির্বাচন করার কোনো অর্থ নেই। রাজপথের বাইরে কোনো সমাধান নেই। তাই রাজপথেই নামতে হবে।

এদিকে নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নে বিএনপির কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে তা ভেবে দেখার কথা বলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক নয়া শতাব্দীকে বলেন, একটি উপযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির আন্দোলনে রাজপথে থাকবে কল্যাণ পার্টি। বিএনপি যদি এগিয়ে আসে আমরা তাদের পাশে থাকব। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি বেঁচে থাকা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন কমিশনের ওপরে।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিএনপি থেকে কোনো প্রস্তাবনা আসে তাহলে আগে সবকিছু দেখে বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিব। তবে আমরা চাই, বিরোধীদলসহ সব রাজনৈতিক দল এবং সরকার এ বিষয়ে সরাসরি একটা রাজনৈতিক আলাপ হওয়া উচিত। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলকে বহাল রেখে শুধু নির্বাচন কমিশন পরিবর্তনের যৌক্তিকতা নেই। সরকার যতদিন পর্যন্ত তাদের নিয়ত ঠিক করবে না, ওপর থেকে ফেরেশতা এনে বসায় দিলেও নির্বাচন কমিশনে কোনো লাভ হবে না। আন্দোলনের জন্য কেউ জোট করবে না, আন্দোলন এবং নির্বাচনের জন্য করতে হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ