পুরান ঢাকার সদরঘাট আর আগের মতো নেই। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার এক বছরের মাথায় জৌলুস হারাতে বসেছে লঞ্চঘাট। ২০২২ সালের ২৫ জুন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়। রাতারাতি বদলে যায় সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলে নির্ধারিত নৌপথ অর্থাৎ ৪১টি রুটের চলাচলের দৃশ্যপট।
পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে দক্ষিণের মানুষের যাতায়াত সহজ তো হয়েছেই, সময় বাঁচার পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। কিন্তু কপালে ভাঁজ পড়েছে লঞ্চ মালিক আর শ্রমিকদের। নিয়ম করে আর ঘাটে লঞ্চের সাইরেন বাজে না। যাত্রী চলাচল অর্ধেকে নেমে এসেছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের বিলাসবহুল ১২টি লঞ্চ। যে কটি আছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নেই।
চলতি বছরের ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে রোটেশন করে প্রতিদিন দুটি লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় লঞ্চ মালিক সমিতি। এতেও সাড়া মেলে না যাত্রীর। সুন্দরবন লঞ্চের কেবিন বয় ফিরোজ জানান, পদ্মা সেতু দিয়ে বাসে গেলে সময় লাগে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। ফলে মানুষ এখন বাসেই বেশি যাতায়াত করছে। যাদের সঙ্গে মালামাল বেশি থাকে তারা বাসে না গিয়ে লঞ্চে যাচ্ছে, অসুস্থ ব্যক্তিরাও কেবিনে যাচ্ছে। রোটেশনে প্রতিদিন দুটি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। এরপর তিন দিন ঘাটে অবস্থান করে চতুর্থ দিনে আবার চলাচল করে। এভাবে করেও লাভ হচ্ছে না লঞ্চ মালিকদের।
লঞ্চ মালিকরা বলছেন, রোটেশন করে আমাদের অনেক লঞ্চ বন্ধ করে শুধু একটা থেকে দুটা ঘাটে রাখা হয়। সেগুলোতেও যাত্রী হয় না। কোনো উৎসবে বিশেষ করে ছুটির সময় হলে যাত্রী একটু বাড়ে। আগে ৪১টি রুটে লঞ্চ চলত। প্রায় সব রুটেই লঞ্চ সংখ্যা কমেছে। রোটেশন করে লঞ্চ চালানো হচ্ছে। অন্তত ১০টি রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ। এর মধ্যে দু-তিনটি রুটে মাঝে মাঝে লঞ্চ চলে। তবে ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে সব রুটেই লঞ্চ চলে। বর্তমান হিসাবে ঢাকা টু চাঁদপুর এবং ঢাকা টু ইলিশা এ দুই রুটে লঞ্চ চলাচলের সংখ্যা বেশি। সব রুটে আগে যেখানে ৯০ থেকে ৯৫টি লঞ্চ চলত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখন তা ৬০ থেকে ৬২টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
সুন্দরবন নেভিগেশনের ৮টি লঞ্চ আগে নদীপথে দাপিয়ে বেড়ালেও এখন মাত্র চারটি চলাচল করছে। বাকিগুলো পোস্তগোলা ব্রিজের কাছে পড়ে আছে। একইভাবে বরিশালগামী পারাবতের তিনটি, মানামীর একটি, অ্যাডভেঞ্চারের একটি, সুরভীর একটি, শতাব্দীর দুটি লঞ্চসহ ১২টি লঞ্চ বন্ধ।
লঞ্চ মালিকদের সূত্রে জানা যায়, গত কোরবানির ঈদের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌরুটে যাত্রী না হওয়ায় তিনটির জায়গায় দুটি একটি করে এরপর ১০টি নৌ-রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। ঢাকা-বরগুনা, ঢাকা-মাদারীপুর, ঢাকা-তুষখালী, ঢাকা-পয়সারহাট, ঢাকা-আমতলী, ঢাকা-পাতারহাট, ঢাকা-টরকী, ঢাকা-রাঙ্গাবালী, ঢাকা-ঘোষেরহাট ও ঢাকা-পাতাবুনিয়া রুটে এখন লঞ্চ চলাচল বন্ধ। লঞ্চ মালিকরা অভিযোগের সুরে বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে গত একবছর আমাদের লঞ্চগুলো অর্ধেকের কম যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। এ অবস্থার জন্য শুধু পদ্মা সেতু নয়, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গুলিস্তান থেকে সদরঘাটের যানজটও দায়ী।
নদীবন্দরের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন সংস্থার পরিচালক মামুন অর রশিদ বলেন, একটি লঞ্চের ৯০ শতাংশ খরচই হয় তেল বাবদ। এরপর শ্রমিক-কর্মচারী, লঞ্চ মেরামতেও অনেক খরচ। একটি বড় লঞ্চ চলতে প্রতি ট্রিপে ৫-৭ লাখ টাকার শুধু তেল-ই লাগে। লঞ্চের আকার ভেদে একটি লঞ্চ চালাতে ২০ থেকে ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রয়োজন হয়। মাঝে মাঝে এই তেলের টাকাও আমাদের ওঠে না। যাত্রীশূন্য হয়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ