ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বাণিজ্যে’ মানহীন আইসিইউ

প্রকাশনার সময়: ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৪:২৫

যেকোনো মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের’ (আইসিইউ) প্রয়োজন হয় শেষ ভরসাস্থল হিসেবে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স-টেকনিশিয়ান, ল্যাবরেটরি সুযোগ-সুবিধার অভাবে সুচিকিৎসার এ শেষ জায়গাটি অনেকটা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশেষায়িত সেবার নামে রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রায় শতাধিক আইসিইউতে নেই ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুমূর্ষু রোগীর জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পর্কিত আইসিইউ খোলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কোনো ধরনের রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হবে— এ সংক্রান্ত কোনো আইন, নীতিমালা কিংবা গাইডলাইনও নেই। আর এ সুযোগে এক শ্রেণির মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে আইসিইউ খুলে বসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ থাকলেও মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম। ফলে অধিকাংশ রোগীকে নিরুপায় হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। আর এ সুযোগে মোটা অঙ্কের কমিশন প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তারা বাণিজ্যে মেতেছেন। এক শ্রেণির অসৎ ডাক্তার, নার্স ও দালাল চক্রের সহায়তায় রোগীর অভিভাবকদের মানসিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বহু সংখ্যক রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক বলেন, চিকিৎসা সেবা এখন ব্যবসা। আর সেই ব্যবসার সবচেয়ে লাভজনক শাখা হলো ‘আইসিইউ’। হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে বেড খালি থাকতে পারে কিন্তু আইসিইউর বেড কখনো ফাঁকা থাকে না।

গত ২১ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার অটোরিকশাচালক রবিউলের সদ্যেজাত সন্তান শ্বাসকষ্টে ভোগায় ঢাকার শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন তিনি। এরপর সিট খালি নেই জানিয়ে কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা শিশুটিকে পাঠিয়ে দেন লালমাটিয়ার মাদার কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ সেপ্টেম্বর মারা যায় শিশুটি। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেন রবিউলকে। বাড়ির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ১ লাখ টাকা দেয়ার পরও শিশুটির লাশ আটকে রাখে মাদার কেয়ার হাসপাতাল। পরে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের হস্তক্ষেপে রবিউল তার সন্তানের লাশ বুঝে পান।

এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি উত্তরার কেয়ার স্পেশালাইজড অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালকে সাত লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অভিযানের সময় আদালত দেখতে পান, সেদিন ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১১ রোগীর ৬ জনকেই আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে। এমনকি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই কয়েকজন রোগীকে সেখানে রাখা হয়।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল মৃত শিশুকে চিকিৎসার নামে আইসিইউতে রেখে তার পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছিল। এমন অভিযোগের পর সেখানে অভিযান চালায় র‍্যাব। এ ঘটনায় জাপান-বাংলাদেশ হাসপাতালের বিরুদ্ধে কেন মামলা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

অপরদিকে একই এলাকায় গত ২৫ জানুয়ারি রিজেন্ট হাসপাতালকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সূত্র জানায়, হাসপাতালটি অতি সাধারণ রোগে আক্রান্তদেরও আইসিইউতে রেখে অর্থ আদায় করছিল। ৩০ শয্যার হাসপাতালটিতে সেদিন ১২ জন রোগীর ৭ জনই ছিলেন আইসিইউতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা বড় বড় হাসপাতালে আইসিইউতে গড়ে প্রতিদিনের খরচ ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। মাঝারি মানের হাসপাতালে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এ বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। ফলে ভিটেমাটি জমিজমা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে গোটা পরিবার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে দেখা যায়, অনুমোদন না নিয়েই সেগুলো আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ চালু করেছে। আর এসব তারা করছে রোগীদের সেখানে ভর্তি করিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়ের আশায়।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (হাসপাতাল-১) ডা. একেএম সাইদুর রহমান বলেন, এসব বিশেষায়িত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অধিদপ্তর কিছু বিশেষ শর্ত ঠিক করে দিয়েছে। নতুন পুরোনো সবাইকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেসব শর্ত মেনে চলতে। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য দ্য মেডিক্যাল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন্স) ১৯৮২ অনুযায়ী শুধু ক্লিনিক বা হাসপাতালের অনুমোদন নিয়ে কেউ আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালাইসিস, মানসিক রোগ ও মাদকাসক্তি এবং ডেন্টাল রোগের চিকিৎসা দিতে পারবে না।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ছোট ছোট যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিক আইসিইউ-এইচডিইউ নিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের এসব স্থাপনের কোনো অনুমতি নেই। এগুলো নিয়ে আগে সরকারের তদন্ত করা উচিত। তিনি জানান, একটি পরিপূর্ণ আইসিইউতে কার্ডিয়াক মনিটর, ইসিজি মেশিন, অটোমেটেড নন ইনভেসিভ ব্লাড প্রেসার অ্যাপারেটাস, ইনকিউবেটর, পালস অক্সিমিটার, ট্রাকেসটমি ট্রে, ইনট্রাকানিয়াল প্রেসার মনিটরিং ট্রে, সার্জিক্যাল কাটডাউন ট্রে, পেরিটনিয়াল ডায়ালাইসিস ইক্যুপমেন্ট, ব্লাড ওয়ার্মিং অ্যাপরেটাস, ইলেকট্রিক ব্রেস্ট পাম্প, মেকানিক্যাল ভেন্ট্রিলেটর, কন্ট্রিনিউয়াস অক্সিজেন অ্যানালাইজার, হার্ট রেট উইথ ডাইসথারমিয়া মনিটরিং মেশিন, রেসপিরেটর ইত্যাদি যন্ত্রপাতি থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় এসব নেই।

তিনি বলেন, অনেক জায়গাতেই অনৈতিক অনেক কিছু হচ্ছে। তবে সব জায়গায় হচ্ছে এটা বলা যাবে না। সাধারণত লাইফ সাপোর্ট তখনই দেওয়া হয় যখন কেউ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যায়। অনেক পরিবারই চায় রোগীকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখতে। এ সুযোগটাই নেয় হাসপাতালগুলো। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে আইসিইউয়ের জন্য পর্যাপ্ত কনসালট্যান্ট নেই, যন্ত্রপাতি নেই, সহযোগী সাপোর্টও নেই।

তিনি আরও বলেন, গলিতে গলিতে ১৫-২০ বেডের হাসপাতালগুলোতেও আইসিইউ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এদের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের চিরুনি অভিযান চালানো উচিত। এসব ছোট ছোট হাসপাতালেই সবচেয়ে বেশি খারাপ-মর্মান্তিক বিষয়গুলো ঘটে, যেগুলো আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, হাতে গোনা স্বল্পসংখ্যক ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত অধিকাংশ হাসপাতালের আইসিইউর গুণমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের অধিকাংশই সঠিক নিয়মনীতি মেনে চলছে না। বহু বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে সাধারণ এমবিবিএস ও নন-মেট্রিক অদক্ষ নার্স কাজ করেন। একজন দুজন কনসালটেন্ট সপ্তাহে ২-১ দিন অন-কলে আসেন।

তিনি বলেন, অধিকাংশ হাসপাতালের আইসিইউ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে। আইসিইউর মতো স্পর্শকাতর ইউনিট খুলতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি না লাগার বিষয়টি ভাবাই যায় না। যত্রতত্র আইসিইউ খুলে ব্যবসা বন্ধে অবিলম্বে আইন করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইসিইউ খোলার অনুমতি দেয়ার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ খোলার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান এবং ল্যাবরেটরি সুযোগ সুবিধা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আইসিইউ রোগীর জন্য প্রতিটি মিনিট ও সেকেন্ড অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। আইসিইউতে সার্বক্ষণিকভাবে যেসব চিকিৎসক ও নার্স কাজ করবে, তাদের অবশ্যই আইসিইউ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের ওপর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। এছাড়া আইসিইউ রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সার্বিক কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে তত্ত্বাবধান করতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ