ঢাকা, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

‘ড্যান্ডি’ নেশায় স্কুলছুটরাও

প্রকাশনার সময়: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৫৬

রাজধানীসহ সারাদেশে দিন দিন বেড়ে চলছে ‘ড্যান্ডি’র নেশা। সহজলভ্য হওয়ায় খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটছে। ‘প্রিয়’ এই নেশায় বেশি আসক্ত রাজধানীর ভাসমান শিশুরা। তবে ভাসমান এসব শিশুর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ দিয়েছে নতুন একটি দল। পোশাকে-আশাকে ছিন্নমূল না হলেও তারাও ‘ড্যান্ডি’ গ্রহণ করছে। এরা সবাই বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করত। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

জানা যায়, রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, বিমানবন্দর এলাকা, সায়েদবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় ড্যান্ডির নেশাগ্রস্ত এসব শিশুর আনাগোনা বেশি। তাদের বয়স আট থেকে দশ বছর। তাদের একটি অংশকে প্রায়ই ড্যান্ডির (জুতার পেস্টিংয়ের আঠা) নেশায় বুঁদ থাকতে দেখা যায়। মূলত ক্ষুধার তীব্র তাড়না মেটাতে ড্যান্ডির মতো ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হচ্ছে পথশিশুরা। এসব এলাকার শিশুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নতুন একটি গ্রুপ। কথা বলার ধরন ও পোশাক দেখলে বোঝা যায় এরা পথশিশু নয়, ভালো ফ্যামিলির সন্তান। এমন ভয়াবহ নেশার নতুন এই গ্রুপটি যোগ হওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে এমন এক শিশুর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম মো. মামুন হোসেন (ছদ্মনাম) তার বয়স ১২। ৬-৭ মাস আগে এ মরণনেশায় আসক্ত হয়েছে বলে জানায় মামুন। কেন এবং কীভাবে এ পথে আসা জানতে চাইলে মামুন বলে, রাজধানীর বসিলার একটি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত সে। ২০২০ সালে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পাশের বাসার এক আপুর কাছে প্রাইভেট পড়তেন। বাসার বাইরে বের হতে দিত না বাবা-মা। বাসার মধ্যেই খেলাধুলা আর পড়াশোনা চলছিল। সময়গুলো ভালো কাটছিল। মামুন জানায়, হঠাৎ পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমাবস্যা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে করোনার প্রথম আঘাত আসে তাদের ঘরে। সরকার ঘোষিত ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে বাবার ফুটপাতের কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ধার-দেনা করে চলছিল সংসার। তারপরও আশা ছিল, একসময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, লকডাউন উঠে যাবে। কিন্তু সেটি আর হলো না। দেনার ভারে ন্যুব্জ মামুনের বাবার সংসার টিকিয়ে রাখাই যেন দায়! বন্ধ হয়ে যায় প্রাইভেট পড়া। সংসার বাঁচাতে রিকশা নিয়ে বের হন বাবা। কিন্তু সেভাবে আয়-রোজগার হতো না। মা অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। তখন বাবা-মাকে সাহায্য করতে মামুন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ে।

মামুনের ভাষায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করি। যে টাকা আয় হতো তা মায়ের হাতে তুলে দিতাম। বোতল কুড়াতে প্রায়ই আসতাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। একপর্যায়ে ড্যান্ডি খাওয়া গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে ড্যান্ডি খাওয়া শুরু করি। এখন ভালোই লাগে। প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে কুড়াতে কোনো কোনো দিন ধানমন্ডি, মালিবাগ, শাহবাগে যাওয়া পড়ে। যখন খুব ক্ষুধা লাগে তখন ড্যান্ডি খাই। এতে ক্ষুধা কমে যায়। অন্যরকম একটা ফিলিংস কাজ করে।

স্কুলে থাকাবস্থায় কখনো এমন নেশাজাতীয় জিনিস গ্রহণ করছ কিনা জানতে চাইল মামুন বলে, এমন জিনিস আগে কখনো দেখেনি। তার মতো আর কেউ ড্যান্ডি গ্রহণ করে কিনা প্রশ্নে বলে শুধু আমি নই। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গ্রুপ আছে। মেয়েরাও আছে। ফিলিংসের জন্য সবাই ড্যান্ডি খায়। অনেক সময় কাছে টাকা থাকে না। তখন দুই বন্ধু মিলে মুচির কাছ থেকে ২০-৩০ টাকার ড্যান্ডি কিনি। তাতে ভালো চলে যায়। আর ভাত খাওয়া লাগে না।

স্কুল খুললে ফের পড়াশোনা শুরু করবে কিনা জানতে চাইলে মামুন বলে, স্কুল খুব মিস করি। বিশেষ করে বন্ধুদের। ফের পড়াশোনা করতে চাই। বাবার ব্যবসাটা ভালো হলে সব ছেড়ে দেব। অনেক দেনা হয়েছে বাবার। করোনা আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। মামুন শুধু একা নয়, করোনা মহামারির ছোবলে শত শত মামুন তৈরি হয়েছে। যারা আজ বই-খাতা-কলম ফেলে সংসারের হাল ধরেছে!

গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি)-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক যথাক্রমে ১৯ ও ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। অথচ মহামারির আগে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ২১ শতাংশ। করোনার প্রভাবে ৩৩ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থীর স্কুল ছেড়ে দেয়ার শঙ্কায় রয়েছে। ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যাপক মানসিক চাপে আছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুলগামী শিশুর ৮ এবং মেয়েশিশুর ৩ শতাংশ কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে এপ্রিল থেকে বন্ধ থাকায় বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি গরিব শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরবে না। যা বিশে^র মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশ। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলেও অন্তত ৯৭ লাখ শিশুর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

ড্যান্ডির আসক্ত থেকে শিশুদের দূরে রাখার বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হেলাল উদ্দিন বলেন, এমন নেশার ফলে শিশুরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এর ঘ্রাণ শরীরের যেসব জায়গায় পৌঁছায়, সেসব জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কাজে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনসহ সবাইকে কাজ করতে হবে। শিশুরা কেন নেশায় আসক্ত হবে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো গভীর মনোযোগ দিতে হবে। চলমান সংকটে শিশুদের মানসিক অবস্থা মাথায় রেখে বিশেষ করে বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি জোর দিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ড্যান্ডি এক ধরনের নেশা। নেশার প্রধান বৈশিষ্ট্য শরীরের ভেতরের যেসব কাজ-কর্ম তা অভ্যস্ত করে তোলা। ফলে ড্যান্ডি নিয়ে শিশুদের মধ্যে এক ধরনের ঔৎসুক্য তৈরি হয়। একজন পথশিশু যখন ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়, তখন অন্য শিশু মনে মনে ভাবে আসলে ড্যান্ডিতে কী আছে। কৌতূহল থেকে আস্তে আস্তে ড্যান্ডিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ