ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

গ্যাস বাণিজ্যে শাস্তির বিধান

প্রকাশনার সময়: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩৫

থামছে না অবৈধ গ্যাস সংযোগ। সকালে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে বিকাল কিংবা রাতেই আবার ব্যবহারকারীরা পেয়ে যাচ্ছেন সংযোগ। এ কাজই চলছে দীর্ঘদিন। অবৈধ এ সংযোগের যত মধু তা ভাগাভাগী হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে। আর এসব অভিযোগের কারণে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বাণিজ্যে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির বিধান সংযুক্ত করে হচ্ছে গ্যাস বিপণন বিধিমালা। জ্বালানি বিভাগ থেকে ইতোমধ্যেই পেট্রোবাংলাকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে এ ধরনের কাজে সম্পৃক্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বিষয়টিকে স্থায়ীভাবে গ্যাস বিপণন বিধিমালাতে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

‘গ্যাস বিপণন বিধিমালা-২০১৯’-এর ৬৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘অবৈধ বা অননুমোদিত বা বিধিবহির্ভূত বা নিয়মবহির্ভূত কার্যকলাপ’ অর্থ সাধারণভাবে বিদ্যমান প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক বা স্থাপনা হতে গ্যাস সংযোগ ব্যবহারের জন্য অনুসৃত বিধান বা নিয়মাবলি অনুসরণ ব্যতিরেকে বা ব্যত্যয় ঘটিয়ে গ্যাস সংযোগ গ্রহণ, প্রদান বা গ্যাস ব্যবহারসহ সমজাতীয় অন্যান্য কার্যকলাপ; একই সঙ্গে ৬৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘গ্যাস কারচুপি’ অর্থ কৌশলে গ্যাস চুরি এবং অবৈধ, অননুমোদিত বা বিধিবহির্ভূত কার্যকলাপের মাধ্যমে রেকর্ডবিহীন বা বিলিংবহির্ভূতভাবে গ্যাস ব্যবহারকে বোঝাবে। কিন্তু এখানের সব দায় গ্রাহকের ওপর চাপানো হয়েছে। কোথাও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করলে কী হবে, তার উল্লেখ নেই। এ দুই ধারার কোথাও বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি এসব কাজে সম্পৃক্ত থাকে তাহলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই।

অপরদিকে ‘গ্যাস বিপণন বিধিমালা-২০১৯’ এ ঠিকাদারদের কারচুপির বিষয়ে ৫৭ ধারায় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, এই ধরায় বলা হয়েছে, গ্যাস কারচুপির সঙ্গে ঠিকাদারের সম্পৃক্ততা। অবৈধ, অননুমোদিত, নিয়মবহির্ভূতভাবে বিতরণ, সার্ভিস, রাইজার, আরএমএস বা অভ্যন্তরীণ গ্যাসলাইন স্থাপন, স্থানান্তর বা সরঞ্জামাদি স্থাপন, স্থানান্তর বা পরিবর্তন বা গ্যাস কারচুপির সঙ্গে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কোম্পানি হতে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি বাতিল এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে স্বীয় কার্য-সম্পাদনে অযোগ্য ঘোষণা করে তাৎক্ষণিকভাবে পেট্রেবাংলার আওতাধীন অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিকে জানাতে হবে এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।’

সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠন করে অবৈধ গ্যাস বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ নেয়ার পর দেখা গেছে, যেখানে লাইন কাটা হচ্ছে সেখানে আবারও সংযুক্ত করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে, এ বাণিজ্যের সঙ্গে বিতরণ কোম্পানির এক শ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত। সাধারণ আইনে তাদের বিচারের ব্যবস্থা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে গ্যাস বিপণন বিধিমালা কোনো কাজে আসছে না। জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এ ধরনের অসাধু কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কী শাস্তি পাবে, সে বিষয়ে গ্যাস বিপণন বিধিমালায় থাকা উচিত। বিষয়ে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি সচিব নুরুল আলম স্বাক্ষরিত একটি বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, এক মাসের মধ্যে গ্যাস বিপণন বিধি সংশোধন করে পেট্রোবাংলাকে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক নয়া শতাব্দীতে ‘মধু অবৈধ সংযোগে!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাসের লোকজনই এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এটা একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, যারা এসব অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে, যাদের দিয়ে সংযোগ করানো বা দেয়ানো হচ্ছে, এগুলো তাদের একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাদের অসাধু কর্মকর্তা, তাদের টিকাদার এর সঙ্গে জড়িত। এতে করে কী হয়, যাদের অবৈধ কানেকশন দেওয়া হয়, তাদের টাকা বেশি খরচ হয়। এগুলো একটা সিস্টেম বানিয়ে ফেলেছে তারা। কারা এসব করছে তা খুঁজে বের করার কাজ গোয়েন্দা সংস্থাকে দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি অবৈধ সংযোগ প্রথমেই কাটার দরকার নেই। আগে সব অবৈধ সংযোগগুলো প্রকাশ করতে হবে। তারপর অন্য একটা সংস্থার মাধ্যমে সেটা সার্ভে করে বের করতে হবে। তারপর সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে হবে। তা না করে অভিযানের নামে মানুষ দেখানো, মানুষ ঠকানো ছাড়া কিছুই না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অবৈধ গ্যাস লাইনের বড় একটা অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরও দুষ্কৃতকারী চক্রের মাধ্যমে আবারও সংযোগ পেয়ে যায়। যদিও তিতাস দাবি করছে, আগের থেকে এটা অনেক কমেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকায় একটি ফেব্রিক্স কারখানায় অভিযান চালায় তিতাস। এ সময় তিতাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কেএম মনিরুল ইসলাম জানান, এ কারখানায় এর আগেও অভিযান চালানো হয়েছিল। সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও এ কারখানায় অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করে কারখানা চালানো হচ্ছে। এদিকে অপরিকল্পিত অবৈধ গ্যাস সংযোগকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীরা রান্নার কাজে ঠিকভাবে গ্যাস না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েছে।

সাভারে আবাসিক খাতে অবৈধ গ্যাস সংযোগকারীর সংখ্যা দিগুণ হওয়ায় চরম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক নাছিম আকতার। তিনি জানান, মূল্যবান এ সম্পদ অপচয় ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই এর দায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। একই সঙ্গে শুধু মূল্যবৃদ্ধি না করে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্য মূল্যবান এ সম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব। কিছুদিন আগে সাভারের গেন্ডা এলাকায় একটি পাঁচতলা বাড়িতে অবৈধভাবে ২০টি চুলায় তিতাসের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে তিতাস কার্যালয়ে অভিযোগ করার পর দুইবার ওই বাড়িটির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই বাড়িটিতে আবার অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে গ্যাস ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আশুলিয়া ও সাভারের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ রকম আরও অনেক ভবন আছে। সবাই জানলেও এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি না। আশুলিয়ার নিউমার্কেট এলাকার লোকজনের দাবি, গত এক বছরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে যতগুলো রাইজার কেটে নিয়েছে তার অধিকাংশগুলোতেই পুনরায় অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকার বৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী সামেলা খাতুন ও গাজীরচট এলাকার মোহাম্মদ রাসেল জানান, ভোর ৫টার পর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য গ্যাস থাকে। এরপর বিকাল ৫টার আগে আর গ্যাস পাওয়া যায় না। বিকাল পাঁচটার পর গ্যাস পাওয়া গেলেও চাপ থাকে না সেভাবে। ডেন্ডাবর এলাকার হাজী ইছামুদ্দিন মাতবরের বাড়ির ভাড়াটিয়ারা অভিযোগ করেন, ভোর বেলা অফিসে যাওয়ার সময় গ্যাসের চাপ কম থাকায় তারা রান্নার কাজ শেষ করতে পারেন না। এ কারণে অনেক সময় অফিস যেতেই বিলম্ব হয়। এমনকি অফিস শেষে রাতে বাসায় ফেরার পর গ্যাসের কারণে খাওয়া-দাওয়াও সময়মতো হয় না।

এ বিষয়ে সাভার আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী অজিত চন্দ্র দেব বলেন, একটা দুষ্কৃতকারী চক্র রাতের আঁধারে এ ধরনের কাজ করে থাকে। দেখা যায়, আমরা দিনের বেলায় তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আসলাম, আবার রাতের আঁধারে তারা সংযোগ নিয়ে নিচ্ছে। যারা এ অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করছে তারা কখনোই স্বীকার করছে না কে তাদের এ সংযোগ দিচ্ছে। আমাদের তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে তাদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। আমরা মামলা করি, এ পর্যন্তই আমাদের কাজ।

তিতাসের মহাব্যবস্থাপক রশিদুল আলম বলেন, একবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরে সেখানে যদি আবারও অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া হয় তবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। তারা আর সংযোগ পায় না।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ আছে যেগুলোর লাইন কেটে দেয়া হলেও গ্রাহকের আঙ্গিনায় রাইজার রয়ে গেছে। এসব সংযোগ ব্যবহার করে বেশকিছু গ্রাহক পরে অবৈধভাবে পুনরায় গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন। এমন অবৈধ সংযোগের কারণে তিতাস গ্যাস একদিকে লোকসানের শিকার হচ্ছে। অপরদিকে এগুলো থেকে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন একটি গ্যাস সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করায় লাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহত হচ্ছে।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ